বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ও শ্রমের অধিকার (মূল প্রবন্ধ)

ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ
অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাভারে রানা প্লাজায় ২৪ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে সংঘটিত দূর্ঘটনায় পোশাক শিল্পের ১,১২৬ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু  জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পোশাক শিল্পে শ্রমের অধিকার নিয়ে আলোড়ন তোলে। এর ফলে শ্রমের মান, শ্রমিক অধিকার এবং কর্মস্থলের পরিবেশ নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। দেশী-বিদেশী আলোচনা এবং কর্মতৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু হলো শ্রম আইন সংশোধন, যেখানে শ্রমিকের জীবন যাত্রার মান অক্ষুন্ন রাখতে ন্যূনতম মজুরী, শ্রমিকের দাবী-দাওয়া নিয়ে মালিক পক্ষের সাথে আলোচনায় সক্ষম শ্রমিক সংগঠন এবং কর্মস্থলে নিরাপত্তা বিধানের জন্য নিরাপদ কর্ম পরিবেশ ছিল মূখ্য আলোচিত বিষয়। ফলশ্রুতিতে যে শ্রম আইন (বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৩) প্রণীত হয় সেখানে শ্রমিকের অধিকার স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হবে সেটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু কার্যত ১৩ মে ২০১৩ প্রণীত দুই বিলিয়ন ডলার পোশাক শিল্পের পুঁজির স্বার্থ সংরক্ষণে মনোযোগী রাষ্ট্রীয় আইন সে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়। শিল্পের জন্মের গোড়া থেকেই বিদ্যমান শ্রম-পুঁজির সংঘাত বহমান থাকে। এই সংঘর্ষে যে বিষয়টি অদৃশ্য সেটি হলো মাল্টি ফাইবার এগ্রিমেন্ট  উত্তর আন্তর্জাতিক পুঁজির ভূমিকা। খবরের কাগজে বহুজাতিক সংস্থার বিশেষ করে আন্তর্জাতিক দোকানদারদের- ওয়ালমার্ট, এইচএন্ডএম, জেসি পেনি, মার্কস এন্ড স্পেনসার, জারা, টেসকো, ক্যারেফোর, গ্যাপ, মেট্রো, কল্স, লেভি স্ট্রাউস, টমি হিলফিগার ইত্যাদি- মানবিক এবং শ্রম-বান্ধব উৎকন্ঠা ও অনুদানের খবর ফলাও করে ছাপানো হয়। সাথে সাথে দেশীয় পুঁজির শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণে অনীহা এবং অপারগতার খবরও ছাপানো হয়। কিন্তু কিভাবে আন্তর্জাতিক পুঁজি দেশীয় দর্জি-পুঁজি এবং শ্রমকে যুগপৎ নিজের তাঁবের মধ্যে রেখে শোষণ করে এবং শেষ পর্যন্ত দেশী সস্তা শ্রমকে নির্মমভাবে শোষণ করতে দেশীয় দর্জি-পূঁজিকে চরমভাবে ব্যবহার করে সেসম্পর্কে আলোচনা ক্ষীণ। এজন্য বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের শ্রম-পুঁজি সংঘাত বুঝতে হলে বিশ্বায়ন তথা বিশ্ব পুঁজির ভূমিকা বোঝা দরকার। এই পুজি সম্পর্কে কার্ল মার্ক্স-এর আপ্ত বাক্যটি স্মরণীয়: “Capital is dead labour, that, vampire-like, only lives by sucking living labour, and lives the more, the more labour it sucks.”

প্রথমেই বিশ্বায়ন সম্পর্কে একটু ধারণা দেয়া প্রয়োজন। রিৎজার  বিশ্বায়নের সাতটি সম্পর্কিত প্রক্রিয়ার কথা বলে: (১) সাম্রাজ্যবাদ (২) নব্য উপনিবেশবাদ (৩) উন্নয়ন (৪) পাশ্চাত্যকরণ (৫) প্রাচ্যকরণ (৬) আমেরিকীকরণ (৭) নব্য-উদারতাবাদ (Neo-Liberalism)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রক্রিয়ায় ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বায়ন ঘটে। তবে সত্তর দশকের আধুনিক বাংলাদেশ এবং তার পোষাক শিল্পের জন্য নব্য-উদারতাবাদ হচ্ছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। নব্য-উদারতাবাদের কারণে শ্রম থেকে পুঁজিতে ক্ষমতার স্থানান্তর হয়, ফলে শ্রমের মজুরী কমে যায় ও চাকরী/কর্মসংস্থান এর অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পায়। অধিকন্তু বেসরকারিকরণ ও নিয়ন্ত্রণহীনতার (deregulation) মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভূমিকা পূন:সংজ্ঞায়ন করা হয় যা প্রয়োগ হয় পণ্য, শ্রম এবং আর্থিক বাজারের নমনীয়তায়। এছাড়া মূল্য স্থিতিশীলতা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হয় মূদ্রাস্ফীতির পূনঃসংজ্ঞায়নের মাধ্যমে।

নব্য-উদারতাবাদ এর প্রধান পুঁজি সঞ্চয়ের ধারাটি হচ্ছে নমনীয় (Flexible)  যা ফোর্ড পরবর্তী (Post Fordist) আমলে সস্তা শ্রম সরবরাহ অক্ষুন্ন রাখার প্রয়াসে প্রান্তিক ও লুন্ঠন সর্বস্ব (peripheral and lumpen) পুঁজি সৃষ্টি করে। সত্তর দশকে এই পুঁজিবাদী সমাজের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্ব পুঁজি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়ার পরিবর্তনের যে ধারায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব সেই একই ধারার বহমানতায় বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের উম্মেষ। এ কারণে বাংলাদেশের প্রান্তিক পুঁজিবাদী সমাজের পোশাক শিল্পের সংকট, বিরাজমান অস্থিরতা, পুঁজি-শ্রম দ্বন্দ্ব এবং শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভূমিকা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে বিশ্ব পুঁজির সংকট এবং সেই সংকট নিরসনের কৌশলগত পরিবর্তনের ধারাটি বুঝতে হবে।

এই নব্য-উদারতাবাদ বাংলাদেশে এক নতুন সঞ্চয়ের ধারার সূচনা করে যাকে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক (Gunder Frank)  লুন্ঠন উন্নয়ন (lumpen development) এবং ডেভিড হার্ভি (David Harvey) বঞ্চনা দ্বারা সঞ্চয় (accumulation by dispossession) বলে আখ্যায়িত করেন যার দ্বারা জনগণকে তাদের সম্পদ ও ভূমির অধিকার হতে বঞ্চিত করে সম্পদ ও ক্ষমতা মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীকরণ ঘটে। সত্তর দশকের পর থেকে আজ পর্যন্ত এই নব্য-উদারতাবাদের ৪টি বৈশিষ্টের কথা হার্ভি উল্লেখ করেছেন:

(১) বেসরকারিকরণ,
(২) অর্থায়নকরণ (Financialization),
(৩) সংকটের ব্যবস্থাপনা ও কৌশলগত-ব্যবহার এবং
(৪) রাষ্ট্রীয় পুনর্বন্টন

(১) বেসরকারিকরণ: এটি সরকারি সম্পদকে বেসরকারি সম্পদ/পণ্যে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় সম্পদকে পুঁজিপতি গোষ্ঠীর হাতে অর্পন করা হয় ফলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা পুঁজিপতি গোষ্ঠীর নিকট স্থানান্তর হয়।

(২) অর্থায়নকরণ: এটি আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে সরকারি নিয়ন্ত্রনের বাইরে রেখে অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার প্রক্রিয়া। এটি তিনটি উপায়ে ঘটে- (ক) পুঁজি বাজার সম্প্রসারণ, (খ) পঞ্জি স্কিম (Ponzi Scheme) বা প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ এবং (গ) প্রতিষ্ঠিত সম্পদ বিনষ্টিকরণ, যা ঘটে মূল্যস্ফীতি ও সম্পদ সংকোচনের মাধ্যমে। সম্পদ সংকোচন ঘটে মূলত দুটি প্রক্রিয়া দ্বারা- ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান একত্রীকরণ ও বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দখল করা (merger and acquisition) এবং ঋণ (Credit) ও পুঁজি বাজার (Stock Market) এর গোষ্ঠীগত স্বার্থে ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণকে সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।

(৩) সংকটের ব্যবস্থাপনা ও কৌশলগত ব্যবহার: এ প্রক্রিয়ায় প্রথমে সুদের হার বাড়ানো হয়। পরে কাঠামোগত পরিবর্তনের শর্ত সাপেক্ষে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নিম্ন সুদে ঋণ দেয়। এই শর্তগুলোকে বলা হয় Structural Adjustment Program (SAP)। এর শর্তগুলো হলো: (ক) ব্যয় সংকোচন, (খ) প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ আহরণ ও সরাসরি রপ্তানিমূলক অর্থনীতি, (গ) মূদ্রার অবমূল্যায়ন, (ঘ) অবাধ বাণিজ্য, (ঙ) সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (ঋউও), (চ) ভারসাম্যমূলক বাজেট, (ছ) মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভর্তুকি উঠিয়ে দেয়া, (জ) সরকারি সম্পত্তি বেসরকারিকরণ, (ঝ) রাষ্ট্রীয় আইনে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অধিকার বাড়ানো এবং (ঞ) সুশাসন প্রতিষ্ঠা।

(৪) রাষ্ট্রীয় পূনর্বন্টন: নব্য-উদারতাবাদে জাতি রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে সম্পদ পূনর্বন্টন নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যূদয় এমন এক সময় হয় যখন বিশ্ব পুঁজি তার মুনাফার সংকটে নিমজ্জিত। এর প্রতিফলন ঘটে ব্রেটন উড্স সিস্টেমে ধ্বস ও OPEC দেশগুলোর কার্টেল এর মাধ্যমে তেল রপ্তানি কমিয়ে দেয়ায়। এর ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (IFIs) এর খপ্পরে পতিত হয়। সেসময় ওঋওং তাদের বৈশ্বিক অবস্থান শক্ত করার জন্য একটি নতুন সঞ্চয় ধারার সূচনা করে যার ভিত্তি ছিল অর্থায়নকরণ এবং নমনীয় শিল্পায়ন (flexible industrialization)। ওঋওং নিজেদের এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য স্থানীয় অর্থনীতিকে সংকটাপন্ন করে তোলে। যার ফলে বাংলাদেশে একটি সাহায্যনির্ভর অর্থনীতি সৃষ্টির মাধ্যমে এর সস্তা শ্রম শোষণ করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পুঁজির পোশাক শিল্পের অনুপ্রবেশ ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর উন্নত পুঁজিবাদী দেশের শ্রমিক আন্দোলন এবং ষাট দশকে শিল্প সমাজ থেকে শিল্পোত্তর সমাজে উত্তরণের প্রেক্ষিতে ঐসব দেশগুলোতে ব্যাপক অশিল্পায়ন (deindustrialization) ঘটে। ফলশ্রুতিতে সেইসব দেশে শিল্পখাতের চেয়ে সেবা খাতের দ্রুত প্রসার ঘটে। পশ্চিমা বিশ্বে শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির ক্রমাগত দাবীর প্রেক্ষাপটে শ্রমিক আন্দোলনের চাপ এড়ানোর জন্য এবং সস্তা শ্রম দ্বারা মুনাফার হার বৃদ্ধির কৌশলগত কারণে শ্রমঘন শিল্প-কারখানাগুলোকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সস্তা শ্রমের দেশগুলোতে স্থানান্তর করা হয়। যেহেতু পোশাক শিল্পের জন্য খুব বেশী মাত্রায় দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়না এবং বাংলাদেশে সস্তায় শ্রম পাওয়া যায়, সেহেতু বিশ্ব পুঁজির চাহিদা অনুযায়ী পোশাক শিল্পের মত একটি শ্রমঘন শিল্প বাংলাদেশে প্রসারের সম্ভাবনা তৈরি হয়। উপরের আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, বিশ্বায়ন তথা বিশ্ব পুঁজিবাদের সাথে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রসারের একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে।

বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের বিকাশে বিভিন্ন কারণের মধ্যে মূলত দুটো কারণ, অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক, উল্লেখযোগ্য। অভ্যন্তরীণ কারণগুলোর মধ্যে সস্তা শ্রম, কম উৎপাদন খরচ, অভ্যন্তরীন চাহিদা, সরকারি সহযোগিতা, back to back letter of credit, এবং বেসরকারি উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। বৈশ্বিক কারণগুলোর মধ্যে কোটা সুবিধা, শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ এবং পণ্যসরবরাহের গতি উল্লেখযোগ্য। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর ঘটে যেমন: আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নির্ভরতা; নারী শ্রমায়ন এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্ম, কর্মনমনীয়তা ও কাজের মান বৃদ্ধি। সারণী-১ এই রূপান্তরকে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে। বাংলাদেশে শিল্পের ক্রমাগত বিকাশের বিপরীতে কৃষির আপেক্ষিক অবনমন লক্ষ্য করা যায়। ১৯৮০-৮১ সালে জিডিপিতে শিল্পের অবদান ছিল ১৭ শতাংশের মত। ২০১০-১১ সালে এর পরিমান দাঁড়ায় ৩০ শতাংশে। অপর দিকে ১৯৮০-৮১ সালে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল তেত্রিশ শতাংশ যা ২০১০-১১ সালে কমে কুড়ি শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত তিন দশক ধরে জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে।

সারণী-১: খাতওয়ারী জিডিপিতে অবদান এবং প্রবৃদ্ধির হার (শতকরা); ১৯৯৫-৯৬ বর্ষকে ভিত্তি ধরে

খাত ১৯৮০-৮১ ১৯৮৫-৮৬ ১৯৯০-৯১ ১৯৯৫-৯৬ ২০০০-০১ ২০০৫-০৬ ২০০৮-০৯ ২০০৯-১০ ২০১০-১১
কৃষি ৩৩.০৭ ৩১.১৫ ২৯.২৩ ২৫.৬৮ ২৫.০৩ ২১.৮৪ ২০.৪৮ ২০.২৯ ১৯.৯৫
শিল্প ১৭.৩১ ১৯.১৩ ২১.০৪ ২৪.৮৭ ২৬.২০ ২৯.০৩ ২৯.৮৬ ২৯.৯৩ ৩০.৩৩
সেবা ৪৯.৬২ ৪৯.৭৩ ৪৯.৭৩ ৪৯.৪৫ ৪৮.৭৭ ৪৯.১৪ ৪৯.৬৬ ৪৯.৭৮ ৪৯.৭২
মোট ১০০ ১০০ ১০০ ১০০ ১০০ ১০০ ১০০ ১০০ ১০০
গড় প্রবৃদ্ধির হার:
কৃষি ৩.৩১ ৩.৩১ ২.২৩ ৩.১০ ৩.১৪ ৪.৯৪ ৪.১২ ৫.২৪ ৪.৯৬
শিল্প ৫.১৩ ৬.৭২ ৫.৫৭ ৬.৯৮ ৭.৪৫ ৯.৭৪ ৬.৪৬ ৬.৪৯ ৮.১৬
সেবা ৩.৫৫ ৪.১০ ৩.২৮ ৩.৯৬ ৫.৫৩ ৬.৪০ ৬.৩২ ৬.৪৭ ৬.৬৩

সূত্র: অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১১, পৃষ্ঠা-২৩

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সস্তা শ্রম বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিকাশের অন্যতম নিয়ামক। এটি শ্রম অধিকার এবং শ্রমিক আন্দোলনের সাথেও সম্পৃক্ত। সারণী-২ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শ্রমের মজুরী সর্বনিম্ন- ঘন্টায় ১৯ সেন্ট যেখানে চীনে ৯০ সেন্ট এবং ভারতে ৪৯ সেন্ট। সারণী-৩ এ পোশাক শিল্পের বিভিন্ন গ্রেড এবং পদের মজুরী কাঠামো উল্লেখ করা হলো। এতে দেখা যায় যে, শ্রমিকের সর্বোচ্চ মাসিক মজুরী হচ্ছে ১১৬.২৫ মার্কিন ডলার এবং সর্বনিম্ন মাসিক মজুরী ৩৭.৫০ মার্কিন ডলার।

সারণী-২: নির্বাচিত দেশসমূহের মাসিক, দৈনিক এবং ঘন্টাপ্রতি মজুরীর হার (মার্কিন ডলারে)

দেশ মাসিক মজুরীর হার দৈনিক মজুরী ঘন্টা প্রতি মজুরীর হার
চীন ১৮৮ ৭.২৩ ০.৯০
ভারত ১০২ ৩.৯২ ০.৪৯
পাকিস্তান ৮২ ৩.১৫ ০.৩৯
লাওস ৮০ ৩.০৮ ০.৩৮
কম্বোডিয়া ৮০ ৩.০৮ ০.৩৮
ইন্দোনেশিয়া ৭১ ২.৭৩ ০.৩৪
ভিয়েতনাম ৭১ ২.৭৩ ০.৩৪
শ্রীলংকা ৫১ ১.৯৬ ০.২৫
বাংলাদেশ ৩৯ ১.৫০ ০.১৯

সূত্র: Financial Express; October ০১, ২০১৩

সারণী-৩: পোশাক শ্রমিকদের মজুরী কাঠামো

গ্রেড ও পদবী মূল বেতন (টাকা) বাড়ি ভাড়া (মূল বেতনের ৪০%) চিকিৎসা ভাতা (টাকা) মোট বেতন (টাকা) মোট বেতন (মার্কিন ডলার)
গ্রেড-১: প্যাটার্ন মাস্টার, চিফ কোয়ালিটি কন্ট্রোলার ইত্যাদি ৬,৫০০ ২,৬০০ ২০০ ৯,৩০০ ১১৬.২৫
গ্রেড-২: মেকানিক, ইলেক্ট্রিশিয়ান, কাটিং মাস্টার ইত্যাদি ৫,০০০ ২,০০০ ২০০ ৭,২০০ ৯০.০০
গ্রেড-৩: স্যাম্পল মেশিনিস্ট, সিনিয়র মেশিন অপারেটর ইত্যাদি ২,৮৭০ ১,১৪৮ ২০০ ৪,২১৮ ৫২.৭৩
গ্রেড-৪: সুইং মেশিন অপারেটর, কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর, কাটার, প্যাকার, লাইন লিডার ইত্যাদি ২,৬১৫ ১,০৪৬ ২০০ ৩,৮৬১ ৪৮.২৬
গ্রেড-৫: জুনিয়র মেশিন অপারেটর, জুনিয়র কাটার, জুনিয়ন মার্কার ইত্যাদি ২,৩৯৫ ৯৫৮ ২০০ ৩,৫৫৩ ৪৪.৪১
গ্রেড-৬: জেনারেল সুইং / বাটন মেশিন অপারেটর ইত্যাদি ২,২৩০ ৮৯২ ২০০ ৩,৩২২ ৪১.৫৩
গ্রেড-৭: অ্যাসিস্টেন্ট সুইং মেশিন অপারেটর, অ্যাসিস্টেন্ট ড্রাই ওয়াশিং ম্যান, লাইন আয়রন ম্যান ইত্যাদি ২,০০০ ৮০০ ২০০ ৩০০০ ৩৭.৫০

সূত্র: ন্যূনতম মজুরী বোর্ড, ২০১০

যে শ্রমিক অসন্তোষের প্রেক্ষিতে পোশাক শিল্প পশ্চিমা বিশ্ব হতে এদেশে স্থানান্তরিত হয় কালের পরিক্রমায় সেই একই শ্রমিক অসন্তোষ স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করে। এই বিস্তারে রাষ্ট্র সরাসরি অবদান রাখে যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৩। এ আইনে মালিক পক্ষের সুবিধার্থে শ্রমিকের সংগঠন করার অধিকার অনিশ্চিত করে; কেননা শ্রম আইনে উল্লেখ রয়েরেছ যে, মোট শ্রমিকের ৩০% সদস্য না হলে ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবেনা। আর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় আগের মতোই ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে। এই আইনে শ্রমিকের সুবিধার্থে গোষ্ঠী বীমা, গ্রাচুয়েটি (যদি চাকুরীর মেয়াদ ১২ বছর হয় তবে মেয়াদন্ত কালে প্রতি বছরের জন্য ১ মাস; যদি চাকুরীর মেয়াদ ১২ বছরের অধিক হয় তবে মেয়াদন্ত কালে প্রতি বছরের জন্য দেড় মাস), স্বাস্থ্য সেবার সুবিধা, অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সরাসরি বেতন প্রদান, সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে মালিক সংগঠন বা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন, ফেডারেশন, আন্তর্জাতিক সংস্থা বা ফেডারেশনের কাছ থেকে সহযোগিতা গ্রহণ এবং শ্রমিকদের জন্য একটি কল্যাণ তহবিল গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, আইনটিতে শ্রমিকের কর্ম পরিবেশে কিছু সুবিধা দিলেও মূল অধিকারের বিষয়টি অবহেলা করা হয়েছে। এমনকি ন্যূনতম মজুরীর বিষয়েও কোন দিক নির্দেশনা নেই। এ থেকে এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেবলমাত্র পুঁজির স্বার্থ তথা বিশ্বপুঁজির স্বার্থে দেশীয় পুঁজির স্বার্থই সংরক্ষণে তৎপর। এই কারণে রানা প্লাজার মতো অবিস্মরণীয় ঘটনার পর আন্তর্জাতিক সুশীল সমাজের চাপ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশী শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সুতরাং অসন্তোষের বীজ থেকেই গেল যা ভবিষ্যতে ব্যাপক শ্রমিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটাবে।

দেশী পুঁজির স্বার্থে রাষ্ট্রের পক্ষপাতমূলক অবস্থানের কারণে রয়েছে দেশী পুঁজির নাজুকতা। বিশ্বপুঁজি যেহেতু এদেশীয় পুঁজিকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রন করে সেহেতু রাষ্ট্র শ্রমিক স্বার্থে পুঁজির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যেতে পারেনা। এ কথা মনে রাখা দরকার যে, শ্রম ও পুঁজি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পুঁজির সম্প্রসারণে যেমন শ্রমের প্রয়োজন তেমনি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পুঁজির বিকল্প নেই। মালিক ও শ্রমিক এই দুই পক্ষের যৌথ প্রয়াসে শ্রম-পুঁজির দ্বন্দ্ব নিরসন সম্ভব হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ বায়ার (বিশ্বপুঁজি) এর উপস্থিতির কারণে তা সম্ভব হচ্ছেনা। এই বিশ্বপুঁজির উপর চরম নির্ভরশীলতাই আমাদের দেশীয় পুঁজিকে নাজুক অবস্থায় নিমজ্জিত রেখেছে। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে সরাসরি প্রবেশের দ্বারা এদেশের পোশাক শিল্পে বিশ্বপুঁজির প্রভাব প্রশমিত করার মাধ্যমে এদেশের শ্রম-পুঁজি দ্বন্দ্ব নিরসন করা সম্ভব।

সস্তা শ্রম ব্যবহার করে অধিক মুনাফা লাভের জন্য পশ্চিমা পুঁজির চাহিদা অনুযায়ী পোশাক শিল্পের যে স্তরগুলো তৈরি হয় তা হলো: কাঁচামাল উৎপাদন, ডিজাইন করা, সেলাই করা, মধ্যস্বত্ব ভোগীদের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য বাজারে বিক্রি। এ স্তরগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মূলত ‘সেলাই করা’ অংশে সীমাবদ্ধ। পোশাক তৈরির এই বৈশ্বিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে পণ্যের উৎপাদন হয় তার বাজার থাকে ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রনে। ফলে তৈরি পোশাকের মূল মালিকানা থেকে যায় বিশ্ব পুঁজির প্রতিনিধি ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলোর নিকট। এই কোম্পানিগুলোর প্রয়োজনেই আমাদের দেশের পোশাক শিল্প পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। বিশ্বপুঁজির কারণে আজ বাংলাদেশের স্থানীয় পুঁজি ও শ্রম উভয়ই চরম সংকটে নিমজ্জিত। যে শার্টটি ইউরোপের বাজারে ১৪ পাউন্ডে বিক্রি হয় সে শার্ট বাংলাদেশে তৈরি হতে মাত্র ২.৬৭ পাউন্ড লাগে। পোশাক শিল্পে নিজেদের বাজার নিশ্চিতকরণ ব্যাতীত এদেশের স্থানীয় শ্রম-পুঁজি দ্বন্দ্ব নিরসন করা সম্ভব নয়। নিজস্ব বাজার সৃষ্টি বা ব্র্যান্ডিং অর্জনের জন্য এ দেশে যথাযথ কোন প্রয়াস সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে মর্মে পরিলক্ষিত হয়না। বিশ্বপুঁজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে নিজস্ব ব্র্যান্ডিংয়ে পণ্য বিক্রি এদেশের শুধু পোশাক শিল্পের সমস্যাই সমাধান করবেনা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শিল্পনীতি নির্ধারণেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

তথ্য নির্দেশ

১. bdnews24.com 12 May 2013
২. GATT কর্তৃক ১৯৭৪-২০০৪ পর্যন্ত আরোপিত কোটা পদ্ধতিতে অনুন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশে পোশাক আমদানি চুক্তি যা পরবর্তীকালে GSP দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। WTO অধিনস্ত এঝচ চুক্তিতে অনুন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশে ৫,০০০ পণ্য শুল্ক মুক্ত প্রবেশাধিকার পায়
৩. Karl Marx, Capital, Volume 1. (Moscow Progress Publishers, 1887, 1964) p. 160
৪. George Ritzer, Globalization: A Basic Text. (Maiden, MA: Wiley-Blackwell, 2010)
৫. নমনীয় পুঁজি সঞ্চয়ের জন্ম হয় উদ্ভাবনী শিল্প কৃতকৌশলের ব্যবহার, খাপ খাওয়ানো আন্তঃপ্রতিষ্ঠান সম্পর্ক, পরিবর্তনশীল সাংগঠনিক কাঠামো এবং বহুমূখী ভোগের ধরণ যা নব্য-শিল্পায়িত দেশের প্রতিযোগিতার মুখে এবং উন্নত দেশগুলোর পণ্য ও বহুখন্ডিত বাজারের প্রতিক্রিয়ায়
৬. Frank Andre Gunder, Lumpen-Bourgeoisie and Lumpen-Development (New York: Monthly Review Press, 1972)
৭. David Harvey,  A Brief History of Neoliberalism (Oxford: Oxford University Press, 2005) pp.160-65

Share This