ড. শফিক উজ জামান
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
পরিচালক, অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. শফিক উজ জামান
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
পরিচালক, অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভূমিকা
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় করণীয় বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে আজকের আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নিজ মেধা ও চিন্তার বিকাশের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে নতুন নতুন উপকরণ উদ্ভাবন ও জ্ঞান সৃজন ব্যতীত অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন সম্ভব নয়। উদ্ভাবনে মনোনিবেশ না করে প্রযুক্তি ও ভোগ্য পণ্য ক্রয়ের মাধ্যমে সাময়িকভাবে সাচ্ছন্দে জীবনযাপন করা যায় কিন্তু এর দ্বারা কখনও মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায় না। অন্যের মুখাপেক্ষী থাকার ফল হিসেবে পরিণামে বরণ করে নিতে হয় পরাধীনতার নতুন পরাকাষ্ঠা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞান উদ্ভাবন ও এর মাধ্যমে নিজেই নিজেদের সমস্যার সমাধান করা। এই জ্ঞান ব্যবহার করেই বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের শিল্প কারখানাগুলো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনছে। জ্ঞান সৃষ্টিতে যেমন গবেষণার কোন বিকল্প নেই তেমনি এই জ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে পৌঁছে দিতে শিল্প উদ্যোগেরও কোন বিকল্প নেই। গবেষণা ও শিল্প উদ্যোগের যুগপৎ পথচলাই এনে দিতে পারে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও সমৃদ্ধি। সারা বিশ্বে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞান সৃজন করছে। এ ক্ষেত্রে গবেষণা কাজে শিল্প উদ্যোগের প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বিপুল মেধা ও অবকাঠামোগত ঐশ্বর্য একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
এই চিন্তা থেকেই এ গবেষণা প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে। উদ্দেশ্য, বিশ্ববিদ্যালয় শিল্প প্রতিষ্ঠান যৌথ গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরা। আমাদের দেশে গবেষণা খাত অবহেলিত, এ বিষয় সম্পর্কে কম বেশি সবাই অবহিত। বলা হয়ে থাকে দারিদ্রই এর মূল কারণ। অথচ ১৯৯৩ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানের খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ড. আব্দুস সালাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সম্বর্ধনা সভায় বলেছিলেন, দরিদ্র বলে গবেষণায় অবহেলা নয়, দারিদ্র বিমোচনের জন্যই গবেষণা বেশি দরকার। তাঁর কথার গুরুত্ব ধরেই বলা যায় শিক্ষা ও গবেষণা খাত গুরুত্ব পেলে দেশ আজ অনেক দূর এগিয়ে যেত। বিশেষ করে শিল্পায়ন ব্যতীত দারিদ্র বিমোচন সম্ভব নয়। আবার শিল্পায়ন দ্রুততর এবং এর ভিত্তি মজবুত করতে হলে গবেষণা দরকার। অপর দিকে গবেষণার পীঠস্থান বিশ্বদ্যিালয়। কিন্তু অর্থাভাবে এবং প্রয়োগিক সাফলতা যাচাইয়ের সুযোগের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা আলোর মুখ দেখছে না। এই অবস্থার পরিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প প্রতিষ্ঠান যৌথ গবেষণার প্রয়োজনীয়তার সম্পর্কে অবহিত করার জন্যই আজকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
আজকের এ প্রবন্ধটি চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত। তবে প্রতিটিই আন্ত:সম্পর্কীত। কেননা শিক্ষা, গবেষণা ও শিল্পায়ন তথা উন্নয়ন একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রথম অধ্যায়ে দুটি অনুচ্ছেদে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আলোচনার পর দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনটি অনুচ্ছেদে বাংলাদেশে শিল্পায়নে গতি প্রকৃতি, শিল্প গবেষণার গুরুত্ব এবং বাংলাদেশের শিল্প গবেষণার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় – শিল্প প্রতিষ্ঠান যৌথ গবেষণার বিভিন্ন দিক আলোচনার পর চতুর্থ অধ্যায়ে মাঠ পর্যায়ে সংগৃহীত তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে উপসংহারে করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
প্রথম অধ্যায়
১। ক) আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা
আমাদের দেশে শিক্ষা কতটা দেশের উন্নয়নমুখী বা বাস্তবমুখী তা কখনও দেশের নীতি নির্ধারণে বা উন্নয়ন পরিকল্পনায় যথেষ্ঠ অগ্রাধিকার পায়নি। তবে সর্বস্তরে মানুষের শিক্ষা গ্রহণে আকাঙ্খা বাড়ছে। কিন্তু বাস্তবমুখী উদ্যোগের অভাবে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো সাধারণ এবং উচ্চ শিক্ষার নামে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। একদিকে শিক্ষার বিষয়বস্তু যেমন বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যহীন, তেমনি যাও শিখছে তার মানও আশানুরূপ নয়। তার পরেও প্রাথমিক শিক্ষার হার বৃদ্ধি কৃষি এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট কিন্তু শস্য বহিভূর্ত গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশেষ করে মৎস্য, হাঁস মুরগী খামার, পশুপালন ইত্যাদি উপ-খাতসমূহ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস, স্বাস্থ্য সচেতনতা সর্বপরি নারীর ক্ষমতায়নে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। তবুও শিক্ষাক্রম যুগের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যহীন হওয়ার কারণে দেশের উন্নয়ন কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে।
দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা তথা অর্থনীতির চাকা জীবন্ত রাখতে সাধারণ শিক্ষার প্রয়োজন আছে। কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থা ক্রমাগত আধুনিকায়ন এবং উচ্চতর প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রীক পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে হলে শুধু সাধারণ শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে তা কখনই সম্ভব নয়। প্রয়োজন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর কারিগরি শিক্ষা। সেই সঙ্গে উৎপাদন ব্যবস্থা এবং প্রতিযোগিতার গতি প্রকৃতি জানার জন্য প্রয়োজন অর্থনীতি, ব্যবসা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার চাইতে উচ্চ শিক্ষা স্তরে সাধারণ শিক্ষার লাগামহীন প্রসারের কারণে শিক্ষা জাতীয় অর্থনীতিতে তেমন কোন অবদান রাখতে পারছে না। শিক্ষার পাঠ্যসূচী গতানুগতিক, লক্ষ্যহীন এবং সমাজের উন্নয়নের আকাংক্ষা দ্বারা পরিচালিত নয়। ফলে উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন এসব উচ্চ শিক্ষায় ডিগ্রি প্রাপ্তদের ভিতর বেকারত্বের হার বেশি। সে তুলনায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণকারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার কম। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে গ্রাজুয়েট ও পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৪৭%, অপরদিকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীদের মধ্যে এই হার মাত্র ৩%।
উচ্চ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বেকারত্বের হার বৃদ্ধি উৎপাদনশীল খাতের কাঙ্খিত মাত্রায় বিকশিত না হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিভংগিও কম দায়ী নয়। আমাদের সমাজে উচ্চ শিক্ষার্থীদের উৎপাদনমুখী যে কোন কায়িক পরিশ্রমকে ঘৃনার চোখে দেখা হয়। দেশের প্রকৌশল বা কারিগরি জ্ঞান নির্ভর কোন কাজ যেহেতু কায়িক পরিশ্রম নির্ভর, সেক্ষেত্রে আয় বেশি হলেও উচ্চ শিক্ষিতরা অনেক কম বেতনে অনুৎপাদনশীল হোয়াইট কালারের স্তরের কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। অপরদিকে কায়িক শ্রম দিয়ে যারা দেশের উৎপাদনকে সচল রেখেছেন তাদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। উৎপাদনমুখী কায়িক শ্রমকে ঘৃনা করার এই সংস্কৃতি উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে আরও বেশি। কাজকে ঘৃনা করে সাহেব (হোয়াইট কালার জব) হওয়ার বিপরীতে উদ্ভাবনী বা উৎপাদনশীল কাজে আগ্রহ নেই। আজও উচ্চ শিক্ষিত বলতে বুঝানো হয় অনুৎপাদনশীল যে কোন মাঝারি বা নিম্ন পদের হোয়াইট কালার চাকুরীজীবিকে। আর স্বল্প শিক্ষিত বা প্রায় নিরক্ষর যারা প্রত্যক্ষভাবে গতর খাটিয়ে স্বল্প মজুরীতে বা আয়ে উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত তাদের কপালে জোটে অশিক্ষিতের “তখমা”।
১। খ) শিক্ষা ব্যবস্থা স্বদেশী উন্নয়ন দর্শন থেকে উত্থিত নয়
একটি দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি নির্ভর করে সে দেশের মানব পুঁজি, বিনিয়োগযোগ্য পুঁজি, জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সমন্বিত করে নিরবিচ্ছিন্ন বস্তুগত সম্পদ ও সেবা উৎপাদনের উপর। অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির গতি যেমন অধিক প্রাকৃতিক সম্পদ বা মানব সৃষ্ট সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে অর্জন করা যায় তেমনি আবার একই সম্পদ অধিক দক্ষতার সহিত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমেও অর্জন করা যায়। এই উভয় ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিকাশের মূলে রয়েছে সামাজিক আকাংখা যার অপর নাম অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা। (আসগর, আ., পৃ: ৪৬) এই সামাজিক আকাংঙ্খা বা অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা দেশ-কাল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। সকল দেশের বাস্তবতা এক নয় এবং ভৌগলিক, রাজনৈতিক ও উন্নয়নের স্তর ভেদে সমস্যার মাত্রা এবং চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা দারিদ্র এবং বেকারত্ব। সমস্যার সূত্রপাতও প্রায় একই উৎস থেকে, তা হলো, শতাব্দী ব্যাপী প্রত্যক্ষ উপনিবেশিক শোষণ। উপনিবেশিক শোষণ থেকে ভৌগলিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রাপ্ত সদ্য স্বাধীন দেশসমূহের শাসকবর্গ অর্থনীতি পুনর্গঠনে প্রাক্তন উপনিবেশিক শক্তিরই দ্বারস্থ হয়। এই সুযোগে প্রাক্তন উপনিবেশিক শক্তি সাহায্যের নামে শর্তযুক্ত ঋণ এবং অসম বাণিজ্য কাঠামোতে সদ্য স্বাধীন দেশ গুলিকে পরনির্ভর করে রাখে। এই পরনির্ভরতার কারণে দারিদ্রের বেড়াজাল থেকে মুক্ত না হয়ে দেশের অভ্যন্তরে একটি অসম অর্থনীতি এবং আয় বৈষম্যের বিষচক্র সৃষ্টি হয় যার সুবিধাভোগীরুপে আতœপ্রকাশ করে রাজধানী কেন্দ্রীক একটি এলিট গোষ্ঠী। বিদেশী আশির্বাদপুষ্ট এই শ্রেণীর হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় দেশের শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি ও প্রশাসন। ব্যাপক ভূমি সংস্কার, সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, কারিগরি ও উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা, স্বাস্থ্য খাত এবং অবকাঠামোকে গুরুত্ব না দিয়ে এক কালের উপনিবেশ ও পরে ঋণ দাতা দেশগুলির ব্যবস্থা পত্রে মূলত: তাদেরই স্বার্থকে সামনে রেখে পরিচালিত হয় দেশ। ফলে ৬ থেকে ৭ দশক পূর্বে স্বাধীনতা পাওয়া এশিয়া ও আফ্রিকার দেশসমূহ এবং প্রায় দুই শত বছর পূর্বে স্বাধীন হওয়া দক্ষিন আমেরিকার দেশ সমূহ আজও অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ থেকে বঞ্চিত।
তবে অনেক দেশই পাশ্চাত্যের প্রেসক্রিপসনের অন্ধ অনুকরণ না করে তাদের উন্নত প্রযুক্তি এবং উন্নয়ন কৌশল নিজ নিজ দেশের বাস্তবতায় প্রয়োগ করেছে এবং এসব দেশ সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো উন্নয়নে। জাপান, কোরিয়া, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া এবং সর্বশেষ চীন এই কৌশল গ্রহণ করে আজ উন্নত দেশের দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছে। এর বিপরীতে, আফ্রিকার অধিকাংশ দেশই নিম্ন আয়ভূক্ত দেশের বেড়াজালে আটকা পড়ে আছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের স্তরে পৌঁছলেও প্রায় চার কোটি দরিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষ নিয়ে উন্নয়নের ভিত্তি এখনও দূর্বল। তবে বাংলাদেশ গত এক দশকে সত্তর ও আশি দশকের নিম্ন প্রবৃদ্ধির হতাশাজনক অবস্থা কাটিয়ে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। এই প্রবৃদ্ধির গতি বৃদ্ধি করে তা ধরে রাখা এবং সর্বস্তরের মানুষের মাঝে পৌঁছে দেয়াই মূল চ্যালেঞ্জ।
ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশে কিছু মৌলিক সমস্যার ক্ষেত্রে মিল পরিলক্ষিত হলেও এসব সমস্যার গভীরতা এবং উৎস নিজস্ব বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতই বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি প্রকৃতি কেবলমাত্র পাঠ্য পুস্তকের নিয়ম কানুন দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। এ দেশের অর্থনীতির কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা একান্তই নিজস্ব। এই বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় রেখেই উন্নয়ন কৌশল নিধারণ করতে হবে। তবে তার অর্থ এই নয় উন্নত দেশের অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অতীতের নীতিমালা দেশীয় বাস্তবতা ও চাহিদা বিবেচনায় না নিয়ে উন্নয়ন কৌশল অনুৎপাদনশীলতা আর অনুকরণ প্রিয়তাকে ঘিরে আবর্তিত। ফলে চিন্তা চেতনায় সৃষ্টিশীলতা উদ্ভাবন ও উদ্দীপনা অনুপস্থিত।
উল্লেখ্য যে, ভাল কিছু অনুকরণ দোষের কিছু নয় যদি তা নিজ দেশের বাস্তবতায় কাজে লাগানো যায়। কিন্তু আমাদের মত দেশে অনুকরণ সেরূপ অনুকরণ নয়। যা আছে তা হলো দেশের বাস্তবতার বাচবিচার না করে অনেকটা অন্ধ অনুকরণ মেনে নেয়া। এই অন্ধ অনুকরণে যে ধারণার জন্ম দিয়েছে তা হলো এক ধরনের পরমুখাপেক্ষিতা এবং এক ধরনের হীনমন্যতা যার প্রভাব পড়েছে আমাদের উন্নয়ন দর্শনে। এর অর্থ আমাদের উৎপাদন, প্রবৃদ্ধি উৎপাদনশীলতার সীমাবদ্ধতা, দূর্যোগ মোকাবেলা, উন্নয়ন, পুঁজি, দক্ষতা ও প্রযুক্তি সব কিছুর জন্য বিদেশীরাই একমাত্র ভরসা (শহীদুল্লাহ শে. মু., পৃ ৭০)। নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ, দক্ষতা ইত্যাদি বৃদ্ধির কোন উদ্যোগের প্রয়োজন নেই। উপনিবেশিক আমলে সৃষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী আজও শিক্ষাক্ষেত্রে তথা সামগ্রিক উন্নয়নের অন্তরায়।
দ্বিতীয় অধ্যায়
২। ক) বাংলাদেশে শিল্পায়ন
দ্রুত শিল্পায়ন উচ্চতর প্রবৃদ্ধির প্রধান শর্ত। শুধু প্রবৃদ্ধির জন্য নয়, শিল্পায়ন ব্যতীত জাতীয় অগ্রগতি সম্ভব নয়। পৃথিবীতে একটি দেশও পাওয়া যাবে না যে দেশটি শিল্পায়ন ছাড়া উন্নত হয়েছে। আর সে জন্য পশ্চিমা দেশসমূহকে উন্নত দেশ না বলে শিল্পোন্নত দেশ বলা হয়। পক্ষান্তরে অনুন্নত বলতে প্রধানত: শিল্পায়নে পশ্চাৎপদ দেশসমূহকেই বুঝায়। এ সমস্ত দেশের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক এবং অনেকাংশে প্রকৃতি নির্ভর। কৃষির উদ্বৃত্ত শিল্পের পুঁজি ও কাঁচামাল হিসেবে কাজ করে। কৃষিতে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করতে হলে প্রকৃতি নির্ভরতা কাটিয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কিন্তু কৃষি কাঠামো পরিবর্তনের পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য কৃষি কাঠামো পরিবর্তনের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। আর আধুনিক প্রযুক্তির সাথে শিল্পায়ন ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। কোন দেশ কত দ্রুত শিল্পায়নে সফল হবে তা নির্ভর করবে ঐ দেশের প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিকাশের উপর। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং এশিয়ার দেশগুলির অগ্রগতির মূলে রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। পক্ষান্তরে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশসমুহের অনগ্রসরতার মূলে বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তিতে পশ্চাৎপদতা। বাংলাদেশের পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণও হিসেবেও একই কথা প্রয্যেজ্য।
স্বাধীনতার ঊষালগ্নে আমাদের অর্থনীতিতে শিল্পের অবদান ছিল নগন্য। অর্থনীতিতে রপ্তানি শিল্পের অবদান উল্লেখ করার মত ছিল না। ১৯৭৩ সালে জিডিপিতে রপ্তানির অংশ ছিল মাত্র ৬ শতাংশ। আশির দশকের শুরু থেকে পোষাক শিল্প রপ্তানি খাতে নতুন মাত্রা যোগ করে। বর্তমানে এই হার ২০ শতাংশ। জিডিপিতে রপ্তানি খাতে গত দুই দশকে এক নাগারে পোষাক শিল্পই দুই তৃতীয়াংশ অবদান রেখেছে এবং আজও অব্যাহত আছে। প্রায় একই ভাবে সত্তর এবং মধ্য আশির দশক পর্যন্ত পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে রপ্তানির সিংহভাগ আসতো। উল্লেখ্য যে, সত্তর ও আশির দশকে রপ্তানির অবদান খুবই কম হলেও তা ছিল এক পণ্য নির্ভর। বর্তমানে জিডিপিতে রপ্তানি খাতে অবদান এক পঞ্চমাংশ এবং এই রপ্তানিই প্রবৃদ্ধির নিয়ামক হলেও আজও আমাদের রপ্তানি এক পণ্য নির্ভর। সত্তর ও আশির দশকে পাট রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে কৃত্রিম আঁশের সাথে প্রতিযোগিতার কারণে। তবে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা বাজার বাড়ছে এবং এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ সবচাইতে উন্নত মানের পাট উৎপাদন করলেও পাটজাত দ্রব্যের বাজার অনেকটাই আজ ভারত ও চীনের দখলে।
তবে পোষাক শিল্পর ক্ষেত্রে পাটের মত বিকল্প সিনথেটিকসের সমস্যা না থাকলেও প্রতিযোগীর সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। অবশ্য মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার দ্বিতীয়টি হলো বস্ত্র এবং বস্ত্রের চাহিদা চিরন্তন। তাছাড়া সীমাহীন বৈচিত্রময়তার কারণে মন্দাকালীন সময়েও এক ধরনের বস্ত্রের চাহিদা হ্রাস পেলে ভোক্তারা অন্যটি দিয়ে পূরণ করে বাজার সচল রাখে। কিন্তু গত তিন দশকে রপ্তানিমুখী পোষাক শিল্প নিরবিচ্ছিন্ন প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে শিল্পায়নে গতি আনলেও এ যাবৎ এই শিল্প প্রতিযোগীতায় টিকে আছে অনেকটা ভর্তুকি মূল্যে গ্যাস, সস্তা বিদ্যুৎ ও সহজলভ্য শ্রমের কারণে। ফলে দীর্ঘদিন শ্রম উৎপাদনশীলতা, পণ্যের গুণগত মান, পণ্যের বহুমুখীতা এবং শ্রম দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টিও গুরুত্ব পায়নি। বিশেষ করে বাজার সম্প্রসারণ বা বহুমুখীকরণে কিছুটা সফল হলেও পণ্য-বহুমুখীতার ক্ষেত্রে কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি নাই। ফলে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই খাতের রপ্তানি অর্জিত প্রবৃদ্ধি দুই অংকের ঘর থেকে এক অংকে নেমে এসেছে। অপরদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো বিশেষ করে ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্তান এবং মিয়ানমারের পোষাক রপ্তানীর অংশ বাড়ছে।
পোষাক শিল্পের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেলেও শিল্পায়নে এ খাতটির মূখ্য ভূমিকা অব্যাহত রয়েছে। তবে তীব্র প্রতিযোগিতামুলক বাজারে এক পণ্য নির্ভরতা রপ্তানী শিল্প অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দেরীতে হলেও আজ আমাদের উদ্যোক্তরা এ বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন।
আসলে ঐতিহাসিক ভাবেই বাংলাদেশের রপ্তানি খাত এক পণ্য নির্ভর। এক সময় ছিল পাট, এখন পোষাক। তবে পার্থক্য এই যে, প্রথমটির অর্ধেক ছিল কাঁচা পাট বা প্রাথমিক পণ্য, শেষোক্তটির প্রায় পুরোটাই শিল্প পণ্য। আজকের প্রতিযোগীতামুলক বাজারে সস্তা শ্রমের উপযোগীতা একদিন নি:শেষ হয়ে যাবে। অথচ অর্থনীতিতে আজও এমন কোন ধারা তৈরি হয়নি যা পোষাক শিল্পের সমান্তরাল বিকল্প হিসেবে কাজ করবে। “ভিশন ২০২১” কে সামনে রেখে শিল্পায়নের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা এক পণ্য নির্ভরতার কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। তাই পণ্যের বহুমুখীকরণ (ফরাবৎংরভরপধঃড়হ) আজ সময়ের দাবী। কেননা শিল্পখাতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি তখনই স্থায়ী গতি লাভ করে যখন উৎপাদনশীলতা এবং পণ্যবহুমুখীতা সমান্তরালে বৃদ্ধি পায়। উৎপাদনশীলতা এবং পণ্যবহুমুখীতা, প্রযুক্তি, কারিগরি জ্ঞান এবং দক্ষতা নির্ভর। বিশ্বের উন্নত দেশগুলি প্রযুক্তির উৎপাদিকা শক্তিকে বরাবরই প্রধান্য দিয়েছে বলেই তাদের অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য। বাংলাদেশে স্বাধীনতার প্রায় সাড়ে চার দশক পরেও শিল্পের আশানুরূপ বিকাশ না হওয়ার কারণ প্রযুক্তি উদ্ভাবন, আহোরণ, অভিযোজন ও সম্প্রাসারণে ব্যর্থতা। শিল্পায়ন ছাড়া যেমন উন্নয়ন সম্ভব নয়, তেমনি প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং বিকাশ ছাড়া শক্তিশালী শিল্পখাত তৈরিও অসম্ভব।
বিগত সাড়ে তিন দশকে পোষাক শিল্পের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটলেও এ খাতটি আজ আবধি বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের সম্পৃক্ত করতে পারেনি। উল্লেখ্য যে, গবেষণালব্ধ জ্ঞান থেকেই প্রয্ুিক্ত আবিষ্কার উদ্ভাবন হয়। পণ্যের গুনগত মান বৃদ্ধি, উৎপাদন খরচ হ্রাস, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার অন্যতম শর্ত। এ দুটি শর্ত পূরণ গবেষণা নির্ভর। কেননা নিত্য নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার, উদ্ভাবন, আহোরণ, অভিযোজন এবং নিরলস, দীর্ঘ কষ্ট সহিষ্ণু গবেষনা আমাদের শিল্পখাত এবং জাতীয় পর্যায়েও অবহেলিত। এই সীমাবদ্ধতা সামগ্রিকভাবে শিল্পের অগ্রগতির অন্যতম প্রধান অন্তরায়।
২। খ) শিল্প গবেষণা কেন?
উন্নয়নের সাথে গবেষণার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। পাশ্চাত্য দেশ সমুহের অগ্রগতির অন্যতম কারণ গবেষণায় ব্যাপক গুরুত্ব প্রদান, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায়। গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তির উদ্ভাবন, তার সফল প্রয়োগ, বিকাশ ও উন্নয়নের উপরই দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি নির্ভরশীল। আজ যে দেশ যত বেশি উন্নত সে দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় তত বেশি বরাদ্দ। দরিদ্র দেশসমূহের শিল্পে পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণাকে অবহেলা। শিক্ষা, প্রযুক্তি গবেষণা এবং মানব সম্পদের উন্নয়ন এই তিনটি উপ-খাতকে অবহেলা করে কোন দেশই উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে পারেনি।
গবেষণার লক্ষ্য জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান আহোরণ এবং জ্ঞান আতœস্থকরণ। গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সফল প্রয়োগে পণ্য উৎপাদন এবং এর গুনগত মান বৃদ্ধি ও নিরবিচ্ছিন্ন সম্প্রসারণ সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কেননা উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সম্প্রসারণ কেবল সমাজে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটায় না; কুসংস্কার, কুপমন্ডুকতা, নৈরাস্যবাদিতা এবং অচলায়তনতা দূর করে।
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিবিড় সংশ্লিষ্টতা ছাড়া শিল্পায়ন কল্পনা করা যায় না। বিজ্ঞানের কাজ হলো গবেষণাগারে নিত্য নতুন জ্ঞানের উন্মেষ ঘটানো, আর প্রযুক্তি সৃষ্ট জ্ঞানকে সফলভাবে প্রয়োগ করে শিল্পায়ন সম্প্রসারণ এবং বিকাশ ঘটায়। কিন্তু প্রযুক্তি কেবল গবেষণাগারে সৃষ্ট জ্ঞানের প্রয়োগিক সফলতায় সীমাবদ্ধ নয়, প্রযুক্তি মানুষকে করে তোলে সৃষ্টিশীল ও আতœবিশ্বাসী। সেই সাথে এটি আর্থিক ও সামাজিক অগ্রগতির মাপকাঠি। অর্থাৎ একটি দেশের সামগ্রিক সমৃদ্ধির বহি:প্রকাশ ঘটে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও বিকাশের মাধ্যমে। পাশ্চাত্যের শিল্পায়িত দেশের অগ্রগতির প্রধান কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার প্রায় ৯০ শতাংশেই ব্যয় হয় উন্নত বিশ্বে এবং স্বত্বাধিকার সনদের (ঢ়ধঃবহঃ ৎরমযঃ) প্রায় ৯৫ শতাংশই উন্নত বিশ্বের দখলে। আসলে কেউ যদি বলে উন্নত ও অনুন্নত বিশ্বের মাঝে এই পাহাড়সম বৈষম্য মূলত: প্রযুক্তিগত তাহলে বোধ হয় একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না।
শিল্পের জন্য প্রয়োজন কাঁচামাল। এই কাঁচামাল হতে পারে খনিজ সম্পদ, কিংবা হতে পারে অন্য কোন প্রাকৃতিক সম্পদ। অর্থাৎ কোন দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধশালী হলে তা সে দেশের শিল্পায়নের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপের স্ক্যানডিনেভিয়ার দেশসহ অপরাপর অনেক দেশই প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতাকে সফলভাবে কাজে লাগিয়ে দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করেছে। কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিন আমেরিকার বহুদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েও দারিদ্রের বিষ চক্র থেকে মুক্ত হতে পারেনি। নাইজেরিয়া, এ্যাঙ্গোলা, সুদান, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, বলিভিয়া, মায়ানমারসহ অনেক দেশ বিপুল মূল্যবান খনিজ সম্পদের অধিকারী হয়েও আজ দারিদ্র। অপর দিকে জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর প্রাকৃতিক সম্পদে দরিদ্র হয়েও পৃথিবীর প্রথম সারির উন্নত দেশ। আসলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে চিরাচরিত কাঁচামালের গুরুত্ব অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। কেননা গবেষণার মাধ্যমে নানা ভাবে কৃত্রিম বস্তু থেকে কাঁচামাল তৈরি হচ্ছে। আবার প্রকৃতি-প্রদত্ত অতি সহজলভ্য বস্তু যেমন চিনা মাটি, পানি কিংবা যত্র তত্র অযতেœ বেড়ে ওঠা আগাছা, যেগুলোকে সম্পদ ভাবাই হতো না, গবেষণার মাধ্যমে বর্তমানে সেসব বস্তু থেকে কাঁচামাল তৈরি হচ্ছে। এসবই গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত নানা প্রযুক্তির ফসল। কেননা প্রযুক্তি, প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদের পরিমানগত এবং গুণগত পরিবর্তন এনে দেয়। উৎপাদনের আকার বা পরিমান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গড় খরচ কমে আসে যা অথনীতির ভাষায় বলা হয় আয়তন জনিত মিতব্যয়ীতা বা বপড়হড়সরবং ড়ভ ংপধষব। নিত্য নতুন পণ্য উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, গুণগত মান বৃদ্ধি এবং ব্যয় হ্রাস প্রতিযোগিতামুলক বাজারে টিকে থাকার উপায়। এক্ষেত্রে শিল্প শ্রম নির্ভরতা কাটিয়ে হয়ে উঠেছে জ্ঞান নির্ভর, তথ্য নির্ভর। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে উৎপাদনশীলতা কায়িক শ্রম থেকে বুদ্ধিগত শ্রমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। (আসগর, আ. পৃ: প্রাগুপ্ত) এর অর্থ এই নয় শ্রম নির্ভরতার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। শ্রম নির্ভরতার সম্পূর্ণ নি:শেষ কোন দিনই হবে না। কিন্তু প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সংস্পর্শে এর মাত্রা এবং চিত্র পাল্টে যাবে। উন্নত দেশের দিকে তাকালেই এর প্রমাণ মেলে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও জ্ঞান ভিত্তিক শিল্পোৎপাদনশীলতা থেকে যোজন যোজন দূরে।
তারপরও শিল্পের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রাকৃতিক সম্পদ কোন দেশের জন্য আশির্বাদ বা অভিশাপ দুটোই হতে পারে এবং তা নির্ভর করছে সে দেশের সরকার এবং জনগণ কিভাবে এবং কোন কাজে ব্যবহার করবে তার উপর। জনসংখ্যাকে মানব সম্পদে পরিণত করা এবং মানুষের মেধা, সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে বিকশিত করার মধ্যেই একটি দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়।
২। গ) বাংলাদেশে শিল্প গবেষণা
প্রতিটি উন্নত দেশের চিত্র লক্ষ করলেই দেখা যাবে শিল্পায়নের প্রয়োজনেই উচ্চ শিক্ষা এবং গবেষণায় বিপুল ব্যয় করা হয়েছে। প্রথম দিকে এই বিনিয়োগের পুরোটাই এসেছে সরকারী কোষাগার থেকে। কিন্তু শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা যখন গবেষণার সুফল ঘরে তুলতে শুরু করলো, তখন নিজেরাও গবেষণায় মনোনিবেশ করলো এবং মূল কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথ উদ্যোগে গবেষণা প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করলো এবং উত্তরোত্তর এই কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পেল যার ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা সস্তা শ্রম নির্ভর নিম্ন মাত্রার উৎপাদনশীলতার ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। তার অন্যতম কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে শিল্পোৎপাদনে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গত পাঁচ বছরে (কাশেম, আ:, কালের কন্ঠ, ২০১০) বাণিজ্য নিয়ে কোন মৌলিক গবেষণা হয়নি। তথ্যটি ২০১০ সালের। তবে এর পরের পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০১০ সাল থেকে আজ অবধি গবেষণা ফলাফল আগের মত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আসলে শিল্পোদ্যেক্তাদের কাছে গবেষণা এখনও অগ্রাধিকারের তালিকায় স্থান পায়নি। শিল্প গবেষণা গুরুত্ব না পাওয়ার অন্যতম কারণ উদ্যোক্তারা এখনও ভর্তুকিনির্ভর সস্তা শ্রমের নিম্ন উৎপাদনশীলতার বেড়াজালেই আবদ্ধ। একজন শিল্পোউদ্যোক্তার দৃষ্টি আবর্তিত থাকবে উদ্ভাবন, সুদুর প্রসারী প্রতিযোগিতার মাত্রা এবং ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জকে কেন্দ্র করে। এসব কিছুর সাথে গবেষণার যোগসূত্র আছে। কিন্তু আমাদের প্রথম জেনারেশেন শিল্পোদ্যোক্তার কাছে যেহেতু গবেষণা ব্যয়বহুল ও কাংখিত ফলাফল প্রাপ্তি দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার তাই তারা এটাকে ঝুঁকিপূর্ণ, অর্থের অপচয় এবং সময় ক্ষেপন হিসেবে দেখেন। গবেষণা ব্যয় বহুল, সময় সাপেক্ষ এবং প্রতিদানে অনিশ্চিত হওয়ার কারণে শিল্পোদ্যোক্তারা গবেষণা খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী নয়। তাছাড়া প্রযুক্তি উদ্ভাবনে নিজ দেশে ব্যয়বহুল বিনিয়োগ না করে বিদেশে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ক্রয়কেই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন।
তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন সকল উদ্ভাবিত প্রযুক্তিই সার্বজনীন নয়। প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা দেশ কাল ভেদে সমান নয়। প্রযুক্তি গবেষণা হয় সংশ্লিষ্ট দেশের সমস্যাকে সামনে রেখে। একেকটি দেশের সমস্যার প্রকার এবং প্রকৃতি ভিন্ন। তাই ভৌগলিক এবং আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ভিন্নতার কারণে একই প্রযুক্তি সকল দেশে সমভাবে কার্যকরী ফল দিবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই (আল-মুতী, আ., পৃ ১১৮)। তবে তার অর্থ এই নয় যে বিদেশী প্রযুক্তির প্রয়োজন নেই। সব প্রযুক্তিই দেশে তৈরী করতে হবে এমন চিন্তাও অবাস্তব। কোন দেশ সে যতই উন্নত হোক না কেন, সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে শিল্পায়ন ঘটায়নি। বিভিন্ন দেশের সাথে যৌথ গবেষণা, প্রযুক্তির আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও বিকাশ ঘটিয়েছে। তাছাড়া যে সব প্রযুক্তি অনায়াসে পাওয়া যায় তা নতুন করে আবিষ্কারের প্রয়োজন নেই। তবে ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, সকল প্রযুক্তিই সর্বত্র সমভাবে কার্যকর নয়। তাই আমদানীকৃত প্রযুক্তি দেশীয় পরিবেশের উপযোগী করতে হলে পরিমার্জন ও পরিবর্তন দরকার। তার জন্য দেশীয় প্রযুক্তির যেমন ন্যূনতম বিকাশ দরকার, তেমনি দরকার কারিগরি জ্ঞান সম্মত প্রযুক্তিবিদ এবং দক্ষ জনশক্তি। এই উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ আশংকাজনকভাবে পিছিয়ে আছে। উল্লেখ্য যে, একটানা ২২৯ বছর (১৬৩৯-১৮৬৮) বিছিন্ন থাকার পর ১৮৬৮ সালে মেইজী পূনরুত্থানের সময় জাপান প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশসমূহের তুলনায় প্রায় একশত বছর পিছিয়ে ছিল। প্রযুক্তিতে এই ব্যবধান দূর করতে নিজস্ব প্রযুক্তি উন্নয়নের পাশাপাশি আমদানীকৃত প্রযুক্তি নিজ দেশের উপযোগী করার কৌশল গ্রহণ করে। অর্থাৎ বিদেশী প্রযুক্তি আতœস্থকরণ, অভিযোজন এবং উন্নয়নের মাধ্যমে দ্রুত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা দূরীকরনের কার্যক্রম হাতে নেয়। যার নাম দেয়া হয় পশ্চিমা প্রযুক্তি জাপানী উদ্দীপনা (ডবংঃবৎহ ঃবপযহড়ষড়মু ঔধঢ়ধহবংব ংঢ়রৎরঃ, গড়ৎরংযরসধ, গ., ঈযধঢ়ঃবৎ ২)। দক্ষিন কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া এবং চীন এ জাপানী কৌশল কাজে লাগিয়ে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে। বাংলাদেশেও এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত করতে পারে। বাংলাদেশের শিল্পায়নে ব্যবহৃত প্রযুক্তি সম্পূর্ণভাবেই আমদানি নির্ভর। জাপানের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন সঠিক প্রযুক্তি চিহ্নিতকরণ, আমদানিকৃত প্রযুক্তি আত্মস্থকরণ এবং অভিযোজন। এবং এ সমগ্র প্রক্রিয়ার সাফল্য নির্ভর করবে দক্ষ জনশক্তি, প্রযুক্তিবিদ, ব্যবস্থাপক এবং উদ্যোক্তা শ্রেণির সক্ষমতা এবং সদিচ্ছার উপর।
তৃতীয় অধ্যায়
৩। বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প প্রতিষ্ঠান যৌথ গবেষণা
বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় প্রযুক্তি গবেষণার প্রজনন ক্ষেত্র। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সামাজিক অগ্রগতির কলাকৌশল সৃষ্টির পীঠস্থান। গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি, উদ্ভাবনী চিন্তা চেতনার বিকাশ প্রধানত: বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন গবেষণা এবং দক্ষ কর্মীদের একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে একত্রিত করে যেভাবে উদ্ভাবন ও উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে, শিল্প প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এককভাবে কিংবা সম্মিলিতভাবেও তা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছবদ্ধ ভাবে গবেষণার সুবিধার কারণে অনেক যুগান্তকারী কিন্তু জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়েছে। আবার বিস্ময়কর আবিষ্কার উপহার দিয়ে সমাজের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করেছে যা বিচ্ছিন্নভাবে গবেষণায় সম্ভব নয়। কেননা গবেষণার জন্য কেবল দক্ষ বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ যথেষ্ঠ নয়, প্রয়োজন নির্দিষ্ট স্থানে স্বল্প দূরত্বে পাশাপাশি পরস্পর সম্পর্কীত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি এমনভাবে গড়ে ওঠা যাতে গবেষণার সাফল্য ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা, বিতর্কের সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই সম্ভব।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে গবেষণা শুরু ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সময়কাল থেকেই। এতিহ্যগতভাবে শিল্প কারখানার মালিকেরা মূলত: ভবিষ্যতের কর্মকর্তা এবং দক্ষ কর্মীবাহিনী তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতার দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির গতিধারা পরিবর্তনের সাথে সাথে তারাও সর্বাধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সন্ধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারস্থ হয়েছে। উল্লেখ্য যে গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি এবং প্রযুক্তি উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া যা অত্যন্ত ব্যয় বহুল। তাই সাধারনত: এর ব্যয়ভার রাষ্ট্রই গ্রহণ করতো। পরবর্তীকালে শিল্প মালিকরা বাণিজ্যিক এবং সামজিক সুবিধা পেতে শুরু করলো, তারাও গবেষণায় মনোনিবেশ শুরু করলো এবং গবেষণার মূল কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথ উদ্যোগে গবেষণা কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি করলো যার ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ শিক্ষাদান, অন্য ভাষায়, জ্ঞান বিতরণ। কিন্তু জ্ঞান বিতরণের আগে প্রয়োজন জ্ঞান সৃষ্টি এবং জ্ঞান আহোরণ এবং তা সম্ভবপর হয় গবেষণার মাধ্যমে। শিক্ষাদান ফলদায়ক হয়ে উঠবে নিত্য নতুন জ্ঞান এবং উদ্ভাবনের সংস্পর্শে এসে। তারা হয়ে উঠবে অনুসন্ধিৎসু, পাবে অনুপ্রেরণা। একজন শিক্ষার্থী যদি গবেষণা না করেই কিংবা গবেষণা সম্পর্কে ধারণা না নিয়েই কেবলমাত্র ভাল রেজাল্ট করে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন, পরবর্তীতে নিছক পদন্নোতির কারণে জার্নাল গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, তবে তার কাছে গবেষণার মূল লক্ষ্য অর্থাৎ জ্ঞান সৃষ্টি এবং জ্ঞান বিতরণ, গৌণ হয়ে পড়বে। এ সম্পর্কে উচ্চ শিক্ষায় গবেষণার গুরুত্ব আরোপ করে ‘কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট’ এ বলা হয়েছে, ‘গবেষণার ফলে শিক্ষাদানের ক্ষেত্র সমৃদ্ধ হয় এবং প্রকৃতি বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গবেষণা লব্ধ আবিষ্কারসমূহ আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে। সুতরাং শিক্ষা উন্নয়নের কথা চিন্তা করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অবশ্যই আমাদের শিক্ষাদান ও গবেষণা বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। উচ্চ শিক্ষার এই মৌলিক নীতি এই দ্বৈত ভূমিকার উপর প্রতিষ্ঠিত” (কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, পৃ: ৬৩)। কুদরত-এ-খুদার শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট আজ অবধি বাস্তবে প্রয়োগের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। উচ্চ শিক্ষা আবর্তিত হয়েছে সরকারী চাকুরী প্রাপ্তি অথবা বহুজাতিক কোম্পানির চাহিদাকে কেন্দ্র করে। আমাদের বিশ্ববিদ্যলয়ে সীমিত আকারে যাও গবেষণা হয়, তার প্রয়োগিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সুযোগ কম। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা উৎপাদনমুখী হয়ে উঠতে পারেনি।
গবেষণায় বিনিয়োগ অপচয় নয়। গবেষণা ব্যয় বহুল এবং এর ফল প্রাপ্তি বিলম্বিত এবং অনিশ্চিত হতে পারে, কিন্তু এতে বিনিয়োগ ব্যর্থ হয় না। একজন বিজ্ঞানীর আবিষ্কার এক দিকে যেমন শিল্প কারখানার কয়েক বছরের উৎপাদন ক্ষমতাকে কয়েক ঘন্টায় অতিক্রম করে গোটা শিল্প খাত পাল্টে দিতে পারে, তেমনিভাবে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেশকে গবেষণা ক্ষেত্রে উচ্চ মর্যাদার আসনে স্থান দিতে পারে।
অধিকাংশ স্বল্পোন্নোত এবং উন্নয়নশীল দেশই দরিদ্র এবং বেকারত্বের কারণে উদ্ভুত সমস্যা মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। ফলে তারা ব্যয় বহুল এবং ফল প্রাপ্তি দীর্ঘ মেয়াদী ও অনিশ্চিত হওয়ার কারণে এটাকে এক ধরনের বিলাসিতা এবং অপচয় মনে করেন। আসলে আমাদের নীতি নির্ধারক এবং শিল্পপতিরা রাতারাতি বিজ্ঞানের সুফল পেতে চান, কাজেই ব্যয় বহুল ও দীর্ঘ মেয়াদী গবেষণায় আগ্রহী নন। কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণাকে যদি তাৎক্ষণিক লাভের উর্ধ্বে বিবেচনা করি এবং ধরে থাকি, তাহলে সাফল্য নিশ্চিত। উন্নত দেশসমূহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়লেও ব্যয় বহুল বিজ্ঞান গবেষণা পরিত্যাগ করে না বরং গবেষণা করেই সৃষ্ট সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবার চেষ্টা করে।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা অগ্রাধিকার না পাওয়া অন্যতম কারণ অকার্যকর উচ্চ শিক্ষার মধ্যেই নিহিত। উচ্চ শিক্ষার প্রসারের সাথে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুষ্পষ্ট সম্পর্ক আছে। কিন্তু বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অধিত জ্ঞান কতটুকু উন্নয়নমুখী বা বাস্তবমুখী তা কখনও উন্নয়ন পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার পায়নি। আমাদের কতজন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, ব্যবস্থাপক ও অন্যান্য পেশা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ লাগবে তা বিবেচনায় রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে না বা সেই অনুযায়ী কারিকুলামও তৈরি হচ্ছে না। বাংলাদেশের মতই অধিকাংশ অনুন্নত দেশে শিক্ষার সাথে কর্মযোগের বিষয়টি একেবারেই গৌণ (ঔড়যহবং,এ.,চ.৩১)। ফলে ভাষা সাহিত্যে ডিগ্রি নিয়ে হয়ে ওঠে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তা, পদার্থ বিজ্ঞান কিংবা রসায়নে ডিগ্রি নিয়ে হতে পারতেন একজন রসায়নবিদ অথবা পদার্থ বিজ্ঞানী, হয়েছেন ইনসুরেন্স কোম্পানির দালাল। ফার্মাসিতে ডিগ্রি নিয়ে পরে বি.বি.এ করে হচ্ছেন ব্যাংক কর্মকর্তা। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পেশায় কাজ করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে তথা গোটা জাতি গঠনে যে অবদান রাখা সম্ভব, পেশার সাথে সামঞ্জস্যহীন ডিগ্রি নিয়ে তা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য জাপানে ১৮৭৭ সালে টোকিওতে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। শিল্পায়নে গতি ত্বরান্বিত করতে প্রথম গ্রাজুয়েট ডিগ্রি প্রাপ্তদের ৯০ শতাংশই ছিল রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান থেকে পাশ করা (গড়ৎরংযরসধ, গ., চ ১৩৫)। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের এসব শাখার পাঠ্যসুচী বা কারিকুলাম তৈরিতে শিল্পোদ্যোক্তাদের সহযোগিতা নেয়া হয় যা আমরা এখনও শুরুই করতে পারিনি।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণার পীঠস্থান বলা হলেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা এখনও সীমিত আকারে প্রাথমিক স্তরেই আটকে আছে। যতটুকু গবেষণা হচ্ছে তার প্রচার এবং প্রয়োগিক সম্ভাব্যতার সুযোগ নেই বললেই চলে। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল, মূল্যায়ন ও তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অনুশীলন এবং সংশোধনের (ঞৎরধষ ধহফ বৎৎড়ৎ) মাধ্যমে প্রায়োগিক সফলতা অর্জন দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ হওয়ার কারণে নীতি নির্ধারকদের এবং দেশের ফার্ষ্ট জেনারেশন শিল্পোদ্যোক্তাদের বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প প্রতিষ্ঠান যৌথ গবেষণায় আগ্রহী করে তোলা কঠিন।
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে বিজ্ঞান গবেষণার বিষয়বস্তু মৌলিক বিজ্ঞান কেন্দ্রীক ছিল। বিজ্ঞান গবেষণায় আর্থিক উন্নয়ন তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। শুদ্ধ জ্ঞান চর্চাই প্রাধান্য পেয়েছে। প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের গতি পায় ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সময় থেকেই। একের পর এক কয়েকটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের সফল প্রয়োগের সূত্র ধরে প্রযুক্তির ডালপালা আরও ছড়িয়ে শিল্প বিপ্লবকে আরও ত্বরান্বিত ও স্থায়ী রূপ দেয়। অর্থাৎ শিল্পায়নের চাহিদা পূরণেই শিল্পোদ্যোক্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব, গত তিন দশক ধরে যে ভাবে এক পণ্য কেন্দ্রীক রপ্তানীমুখী শিল্পায়ন চলছে তাতে এমন কোন চাহিদা সৃষ্টি হয়নি যা গবেষকদের সম্পৃক্ত করে। হয়তো বা তাই। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাও মূলত: একাডেমিক, শুদ্ধ জ্ঞান চর্চা কেন্দ্রীক। প্রায়োগিক গবেষণার সুযোগ কম।
তাছাড়া একাডেমিক গবেষণা কোন কোম্পানির কার্যক্রম তখনই প্রভাবিত করতে পারে যখন বিশ্বদ্যিালয়ের গবেষণা উক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা, কার্য পদ্ধতি তথ্যাবলী এবং কৌশল সম্পর্কে জ্ঞাত থাকে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় গবেষকদের কার্যক্রম শুধু শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাথে ক্যাম্পাসে আলোচনা সীমাবদ্ধ না রেখে স্ব-শরীরে কারখানা পর্যবেক্ষণ জরুরী। এখানে শুধু মেশিন ও যন্ত্রাংশের তথ্য সংগ্রহ নয় স্ব-শরীরে পর্যবেক্ষণে অনেক প্রচলিত কিন্তু অলিখিত জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে যা গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে যুক্ত হতে পারে।
যৌথ গবেষণায় শিল্প প্রতিষ্ঠান পায় প্রযুক্তিগত জ্ঞান, তথ্য ও উপাত্ত আর বিশ্ববিদ্যালয় পায় প্রয়োজনীয় অর্থ যা দিয়ে সৃষ্ট জ্ঞানের কার্যকারীতা প্রমাণের সুযোগ পায় আর সমাজ পায় নতুন পণ্য প্রযুক্তি। অর্থাৎ একটি ভারসাম্যমুলক কর্ম থেকে সবাই উপকারভোগী (ইসলাম, ন., আ.দি.বাংলাদশ. ৭ম পরিচ্ছদ)।
কোন একটি গবেষণা প্রকল্প সফল বা অসফল তা থেকে যে তথ্যটি পাওয়া যায় তা হলো কোনটি কার্যকর আর কোনটি কার্যকর নয় এবং কোনটি কেন কার্যকর আর কোনটি কেন কার্যকর নয়। এসব বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্য মূল্যায়ন এবং বিশ্লেষণ করে পরবর্তী প্রকল্প হাতে নেয়ার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ মেয়াদী এবং ব্যয় বহুল যা কোন বিচ্ছিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। একটি উচ্চ মাত্রার স্থায়ী প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন নিরবিচ্ছিন্ন উৎপানশীলতা বৃদ্ধি আর তা নির্ভর করে নিত্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, অভিযোজন, আতœস্থকরণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির উপর। এজন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ।
চতুর্থ অধ্যায়
৪। জরিপের ফলাফল
আজকের প্রবন্ধটি মূলত: বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ, বই, জার্নাল এবং বিভিন্ন দৈনিক বা সাময়িকীতে প্রকাশিত সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে তৈরি করা হয়েছে। এ সমস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য উপাত্তের যথার্থতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পকারখানার গবেষণা সম্পর্কীত বিষয়াদী জানতে সীমিত আকারে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। দেশের প্রতিষ্ঠিত ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় (তন্মধ্যে ৯টি সরকারী এবং ৩টি বেসরকারী মালিকানাধীন) এবং ৯টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত শিক্ষক এবং মালিক/ কর্মকর্তাদের সাক্ষাতকারের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
শিল্প কারখানা হতে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় ৯টির মধ্যে ৭টিতে গবেষণা কার্যক্রম চালু আছে, কিন্তু তাদের গবেষণার ফলাফল কোথাও প্রকাশিত হয়নি এবং নিজেদের উদ্ভাবিত কোন পণ্যের প্যাটেন্ট আছে কিনা জানা যায়নি। শুধু মাত্র ২টি প্রতিষ্ঠান রানার এবং বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে গবেষণা সহযোগিতা আছে।
দেশের প্রতিষ্ঠিত ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিভাগ/ইনস্টিটিউটে যৌথ গবেষণা থাকা সম্ভব এরূপ ১২৭টি বিভাগ/ইনস্টিটিউটে জরিপ চালানো হয়েছে। জরিপকৃত মোট ১২৭টি বিভাগ/ইনস্টিটিউটের মধ্যে মাত্র ২৭টি (২১.২৬%) বিভাগ/ইনস্টিটউটে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ গবেষণা রয়েছে। ১০৭টি বিভাগ/ইনস্টিটিউট (৮৪.২৫%) বলেছে তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ গবেষণায় সক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া জরিপকৃত মোট ১২৭টি বিভাগ/ইনস্টিটিউটে গবেষণা করছেন এরূপ শিক্ষক রয়েছেন ২৫৬৩ জন যাদের মধ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ গবষণায় যুক্ত আছেন মাত্র ১৮৩ জন (৭.১৪%)।
অপর দিকে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৭টি বিভাগে জরিপ চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প প্রতিষ্ঠান যৌথ গবেষণা সম্পর্কীত প্রাপ্ত তথ্যাবলীতে দেখা গিয়েছে ৪৫ জন উত্তর দাতা (৩৫.৪৩%) শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারখানার সাথে যোগাযোগের অভাবকেই যৌথ গবেষণা না হওয়ারে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৫ জন উত্তর দাতা (১৯.৬৮%) অর্থের অভাব এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৫ জন (১৯.৬৮%) ঝুঁকিপূর্ণ বলে আগ্রহের অভাবকে যৌথ গবষণা না হওযার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য ৩ জন উত্তর দাতা জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা এমন কিছু চান যা থেকে পণ্য দ্রুত বাজারজাত করা যাবে এবং মুনাফা আসবে। অর্থাৎ গবেষণার গুরুত্ব বুঝলেও দীর্ঘমেয়াদী কোন প্রকল্পে উদ্যোক্তাদের উৎসাহ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিলে গবেষণার সূচনা হত এমন জবাব দিয়েছে ১১ জন উত্তর দাতা (৮.৬৬%)।
সরকার থেকে নীতিমালার ভিত্তিতে যৌথ গবেষণায় উদ্যোগ নেয়ার অভাব রয়েছে এমন জবাব দিয়েছেন ৪ জন (৩.১%)। অপর দিকে শিল্পকারখানার উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন ৮ জন উত্তর দাতা (৬.২৯%)। শিল্পমালিকেরা গতানুগতিকতায় বিশ্বাসী, নতুনত্বে আগ্রহী নন এমন দৃষ্টি ভঙ্গীর কথা বলেছেন ৫ জন (৩.৯৩%) এবং আর এন্ড ডি (জ ্ উ) সম্পর্কে তাদের ধারণাই নাই এমন বলেছেন ৮ জন (৬.২৯%)। অবকাঠামো এবং প্রযুক্তির অভাবের কথা বলেছেন ৭জন (৫.৫%)। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর দাতারা ঢাকা থেকে দূরত্ব এবং ঐ এলাকায় শিল্প কারখানার অভাবকেই যৌথ গবেষণা না হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ২জন উত্তর দাতা (১.৫৭%) বলেছেন যে, শিক্ষা কারিকুলামের সাথে শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে মিল নেই বলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক কেউ শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ গবেষণায় আগ্রহী হয় না।
দুইজন উত্তর দাতা (১.৫৭%) বলেছেন শিক্ষকেরা যা গবেষণা করেন তার কোন মূল্যায়ন নেই বলেই কেউ যৌথ গবেষণায় আগ্রহী হন না। তাছাড়া ক্লাশ, পরীক্ষা নেয়ার পর শিক্ষকদের সময় না পাওয়াকে একজন উত্তর দাতা যৌথ গবেষণা না হওয়ার কারণ বলে জানিয়েছেন। যৌথ গবেষণা করা হয় একটি ভিশনকে কেন্দ্র করে। এই ভিশন সম্পর্কে অবহিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই উদ্যোগই নেয়া হচ্ছে না এমন জানিয়েছেন ৪জন (৩.১৪%)।
বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যও গবেষণায় এ সব প্রতিষ্ঠান এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে তা নি:সন্দেহে বলা যায়। এটা ঠিক মাত্র ৯টি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পৌঁছলে তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে। তথ্য সংগ্রহের জন্য ২০টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে তথ্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে ৮টি আগ্রহ দেখাননি, ২টি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখিয়ে ছিলেন কিন্তু ব্যবসায়ীক কাজে বেশি ব্যস্ত থাকার কারণে সময় দিতে পারেননি। একজন বিদেশে থাকার কারণে সাক্ষাৎ করা যায়নি। এহেন সীমাবদ্ধতা সত্বেও গবেষণা প্রবন্ধ, জার্নাল, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য উপাত্ত থেকে শিল্প কারখানায় গবেষণার যে চিত্র পাওয়া যায় তার সাথে উত্তরদাতাদের বক্তব্য যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ। শিল্প কারখানায় গবেষণার মাধ্যমে নতুন পণ্য উৎপাদন, নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি কিংবা বিদেশী প্রযুক্তি থেকে দেশের উপযোগী প্রযুক্তির উন্নয়নে অগ্রগতি কাঙ্খিত মানে নেই। এমন কি আমাদনিকৃত প্রযুক্তি ব্যবহারেও বিদেশী বিশেষজ্ঞ নির্ভরতার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, দেশীয় কারিগরি প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা ফ্যাক্টরিতে কাজের চাইতে কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে হোয়াইট কালার জব করতেই আগ্রহী বেশী। তদুপরি যারাও ফ্যাক্টরিতে যোগ দিতে আসেন বিদেশীদের তুলনায় আন্তরিকতা ও দক্ষতার যথেষ্ট ঘাটতির কারনেই মালিকরা তাদের নিয়োগ দিতে আগ্রহী হন না।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথ গবেষণা না হওয়ার প্রধান কারণ যোগাযোগের অভাব ছাড়াও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ না হওয়া অন্যতম প্রধান কারণ। অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠানই এখনও দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেন নি। তারা স্বল্প সময়ে মুনাফা পাওয়া কেন্দ্রীক গবেষণায় আগ্রহী। গবেষণা ও উন্নয়ন অধিকাংশ কারখানার কাছেই নতুন বিষয়। শিল্পায়ন যতটুকু হয়েছে তা প্রধানত: আধা প্রস্তুত পণ্য থেকে পূর্ণ প্রস্তুত পণ্য করা পর্যন্ত। যদিও অনেক দেশই এভাবে শিল্পায়ন শুরু করে ক্রমান্নয়ে শিল্পে বৈচিত্রতার সৃষ্টি করেছে এবং গবেষণার স্বার্থেই বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দৃশ্যমান অগ্রগতি নাই।
উপসংহার
শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতার মূখ্য উদ্দেশ্য নিত্য নতুন উদ্ভবন ও তার প্রায়োগিক সাফল্য যাচাই করা। এই প্রায়োগিক সফলতা যাচাই ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা নেহায়েত শুদ্ধ জ্ঞান চর্চাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পরে। গবেষণাগারে সৃষ্ট জ্ঞানের কার্যকারীতা প্রমানিত হলে লাভবান হয় শিল্প প্রতিষ্ঠান, গবেষককে করে তোলে আরও আতœবিশ্বাসী, শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষাদান হয়ে ওঠে আরও আকর্ষনীয় এবং অনুসন্ধিৎসু। তারা হয়ে ওঠে আরও জ্ঞান পিপাসু। তাছাড়া শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সংশ্লিষ্ট তথ্যাবলী সম্পৃক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচী তৈরি করলে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞানের সেতু বন্ধন সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থী হয়ে ওঠে দক্ষ ও অভিজ্ঞ। এই অভিজ্ঞতা একদিকে যেমন উদ্ভাবনী শক্তির উন্মেষ ঘটায়, তেমনি নিজ নিজ পেশার জ্ঞান ভান্ডারকে করে তোলে আরও সমৃদ্ধ।
ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে গত তিন দশকে রপ্তানি মুখী পোষাক শিল্পকে কেন্দ্র করে শিল্পায়নে যে অগ্রগতি হয়েছে তার সঙ্গে শিল্প গবেষণার অবদান নেই বললেই চলে। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কেন্দ্র স্থল হলেও শিল্প কারখানার সাথে সহযোগিতার অনুপাস্থিতির কারণে তাদের গবেষণা লব্ধ ফলাফল যাচাইয়ের সুযোগ নেই। গবেষণা ব্যয়বহুল ও ফলাফল প্রাপ্তি দীর্ঘ মেয়াদী এবং অনিশ্চিত, ফলে রাষ্ট্রই প্রধানত: এর ব্যয়ভার মেটায়। প্রথম পঞ্চ বাষির্কী পরিকল্পনায় এবং কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে উপেক্ষা করে ক্রমন্নয়ে শিক্ষা বাজেট হ্রাস করা হয়েছে। শিক্ষা খাতের বরাদ্দই যখন গুরুত্ব পায়নি, সেখানে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি না পাওয়াই স্বাভাবিক। ফলে গবেষণা খাত অবহেলিতই থেকেছে। ২০১৩ সালে বিশ্ব ব্যাংক রিপোর্টে বিশ্বের উন্নত অনুন্নত ৮০টি দেশের গবেষণা খাতে জিডিপি’র অবদান তুলে ধরা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের নাম নেই। আসলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারকরা প্রযুক্তি গবেষণার সাথে অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য সহযোগিতার সম্পর্কে যথেষ্ঠ সচেতন নন। ফলে রাষ্ট্রীয় ভাবে এই সহযোগিতা ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না ( জোয়ারর্দার, গো. কা., পৃ ৫৫-৫৬)।
রাষ্ট্রই যেখানে গবেষণার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বরাদ্দ বৃদ্ধিতে আগ্রহ দেখায়নি, দেশের প্রথম জেনারেশন শিল্পপতিদের গবেষণায় আগ্রহ জাগানো কঠিন। তারপরেও, শিল্পপতিদের যৌথ গবেষণায় আগ্রহী করে তোলার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদেরই। আর শিল্পোদ্যোক্তরা আগ্রহী হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণালব্ধ জ্ঞান, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির প্রায়োগিক সফলতা অর্জনের মাধ্যমেই। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় বা গবেষণা থেকে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বা পণ্য থেকে শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ীক সুবিধা পেলে শেষোক্ত প্রতিষ্ঠান শুধু আগ্রহী হবে না স্বেচ্ছায় যৌথ গবেষণায় এগিয়ে আসবে। উদ্ভাবিত পণ্য বা মেধা থেকে ভোক্তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপকৃত হলে উভয় প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধি পাবে। দেশ এগিয়ে যাবে।
তথ্যসূত্র
১. আসগর, আ., শিক্ষা ও উন্নয়ন প্রত্যাশা, আগামী প্রকাশনী ১৪০৪ পৃ: ৪৬
২. Campbell, J. C. Culture, Innovating, Borrowing and Technology Management Practices, in: Liker, J.F., ed., Engineered in Japan: Japanese Technology Management Practices, Oxford University Press, 1995
৩. কাশেম, আ: কালের কন্ঠ, ৪ জুন, ২০১০
৪. Morisuima. M., Why has Japan succeeded? Western Technology and the Japanese ethos, Cambridge University press, 1981.
৫. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, নভেম্বর ১৯৯৬
৬. ইসলাম, ন., আগামী দিনের বাংলাদেশ, প্রথমা ২০১১, ঢাকা
৭. শহীদুল্লাহ, শে. মু., অনুন্নয়ন অভিশাপ: রাহুমুক্তির মনোসামাজিক দিগ্দর্শন, পরমা ঢাকা ২০০০।
৮. জোয়ার্দার, গো.,কা., বাংলাদেশের উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তি সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৬, আল-মুতী, আ., শিক্ষা ও বিজ্ঞান নতুন দিগন্ত, অনুপম প্রকাশনী ঢাকা, ১৯৯১
৯. Johnes, G., The Role of Science and Technology in Developing countries, London, 1971