ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
সাবেক গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংক
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
সাবেক গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংক
বৈশ্বিক মন্দার পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনও আমরা বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কিছু চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু অর্থনীতির পূর্ণাঙ্গ পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম এখনও আশাব্যঞ্জক নয়। এই পুনরুদ্ধারের চিত্রগুলো আবার সব জায়গায় একই রকম নয়। কিছু উন্নত দেশে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চিত্র ভালো পরিলক্ষিত হলেও অন্য দেশগুলোর অবস্থা দূর্বল। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর তুলনা করলে দেখা যায় এশিয়ায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার খুব দ্রুত এবং শক্তিশালীভাবে হচ্ছে যেখানে চীন এবং ভারত নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাছাড়া একই অর্থনৈতিক অঞ্চলে (উন্নত এবং উন্নয়নশীল) এই পুনরুদ্ধারের গতি দেশ ভেদে ভিন্ন হচ্ছে। নিচের ছকে বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশের জিডিপি বৃদ্ধির (শতকরা পরিবর্তন) তুলনামূলক চিত্র দেখানো হলো।
২০০৯ | ২০১০ | ২০১৩ | ২০১৫ | |
বিশ্ব | ০.৫-১.০ | ১.৫-২.৫ | ৩.৩ | ৩.৮ |
যুক্তরষ্ট্র | -২.৬ | ০.২ | ২.২ | ৩.১ |
ইউরো অঞ্চল | -৩.২ | ৩.৫-৪.৫ | -০.৪ | ৫.০ |
উন্নয়নশীল দেশসমূহ | ১.৫-২.৫ | ৪.৭ | ৫ | |
চীন | ৭.৭ | ৭.১ | ||
ভারত | ৫.০ | ৬.৪ | ||
জাপান | ১.৫ | ০.৮ | ||
বাংলাদেশ | ৬.১ | ৬.২ |
বৈশ্বিক আর্থিক খাত ও অর্থনীতির মন্দা শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে যার প্রধান কারণ ছিল গৃহায়ন বুদবুদ (Housing Buble)। যার সাথে যোগ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাব- প্রাইম বন্ধকী বাজারে আক্রমণাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ ব্যবস্থা ও আর্থিক খাতের শিথিল নিয়ন্ত্রণ। আর্থিক খাত ও অর্থনীতিতে মন্দা এভাবে শুরু হওয়ার তা ছড়িয়ে পড়ে ঐ সমস্ত শিল্পে যেগুলো আর্থিক খাতের ঝুঁকিপূর্ণ লেনদেনের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণগুলো ২০০৭ সালে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এই লক্ষণগুলোর সমাধান করার নীতি গ্রহণ না করে বরং এমন নীতি গ্রহণ করা হয় যা সমস্যাকে আরও বিস্তৃত ও গভীর করে ২০০৮ সালের শেষ দিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় রূপ দেয়। অর্থনৈতিক মন্দা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুব দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে যদিও সবচেয়ে ক্ষতি করে বৈশ্বিক আর্থিক খাত, বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং উন্নত অর্থনীতিকে। বেশি পরিমাণন মন্দায় আক্রন্ত দেশের সরকারগুলো তাদের আর্থিক খাত এবং মুল অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে যার মধ্যে ছিল বড় বড় শিল্প ও আর্থিক খাতগুলোকে জনগণের টাকায় বেল আউট করা (শিথিলতম শর্তে অর্থ দেয়া) । সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো ২০১৫ সালে এসেও আমরা এ মন্দা হতে সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার হতে পারিনি।
যুক্তরাষ্ট্র তার আমদানি-রপ্তানির যে ব্যবধান যাকে চলতি হিসাব ঘাটতি (current account deficit) বলা হয় তা গত কয়েক দশক ধরে অন্য দেশগুলোতে রপ্তানি করে যা মন্দার অনুঘটকের সুত্রপাত ঘটায়। যুক্তরাষ্ট্রের ডলার বিশ্বের রিজার্ভ মূদ্রা (current) হওয়ায় সে দেশের সরকার দীর্ঘকাল ধরে শিথিল সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করে আসছে। এই নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ঘাটতি পূরণ করা হয অন্য যে দেশগুলো যাদের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ধনাত্মক তাদের দ্বারা (যুক্তরাষ্ট্রকে তারা স্বল্প সুদে ডলার ঋণ দেয়)। ১৯৮০ এর দশকে অভ্যন্তরীণ মন্দার পর যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান পল ভলকার যে নীতির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে, যুক্তরাষ্ট্র এবার সেই নীতি গ্রহণ করেনি। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতে নিজস্ব কোন সমতার নীতিও গ্রহণ করেনি। বাজেট নীতি ক্লিনটনের সময় সমতায় ছিল কিন্তু সেসময় ব্যক্তি খাতে আয় ও ব্যয়ে কোন সমতা ছিলনা। পরবর্তীতে বুশের সময়ে সরকারি এবং ব্যক্তি উভয় খাতেই কোন সমতার নীতি গ্রহণ করা হয়নি)।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের শিথিল মুদ্রা ও বাজেট নীতির কারণে বাজারে যে সহজ মূদ্রা প্রবাহ (তারল্য) ঘটে তা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় বিভিন্ন অনির্দিষ্ট দিকে বিনিয়োগ করা হয়। এর ফলাফল স্বরূপ (১) পণ্য দ্রব্য ও সম্পদের বুদবুদ (commodity and asset buble) সৃষ্টি হয় (যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বিংশ শতাব্দির শেষের দিকে ডট কম বুদবুদের (dot com buble) বিস্ফোরণের কারণে যে মন্দার সৃষ্টি হয়েছিল গৃহায়ন বুদবুদ সৃষ্টি হওয়ার ফলে তা কিছুটা লাঘব হয়); (২) অনিয়ন্ত্রিত শিথিল ব্যবস্থার কারণে equity buyback (বাজারে বিদ্যমান নিজ শেয়ার কোম্পানি কর্তৃক ক্রয়) শুরু হয় (পূনরায় equity ক্রয়ের কারণে কোম্পানির equity এর উপর লাভ বৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু অপর পক্ষে কর্পোরেট আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা আরও শোচনীয় অবস্থায় পতিত হয়); (৩) এরূপখাতে ঋণ দেয়া হয় যেখানে ঋণ গ্রহীতার ঋণ পরিশোধের সামর্থ অস্পষ্ট; (৪) জটিল এবং অস্পষ্ট ডেরিভেটিভে (derivative) বিনিয়োগকরা হয় যার ভেতরে ঝুঁকির পরিমাণ ইচ্ছাকৃতভাবে অপ্রদর্শিত রয়েছে।
যেহেতু পুরো বিশ্বব্যবস্থাই বিশ্বায়নের কারণে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত তাই যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ও শিল্পখাতের এই প্রবণতা অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে, ঐসমস্ত দেশসহ যারা আর্থিক খাত ও বাজেটে সাম্যাবস্থার নীতি গ্রহণ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের শিথিল মুদ্রানীতির ফলাফল সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্য সে সব দেশের অর্থনীতিতে প্রতিফলিত হয় যাদের মূদ্রার মান যুক্তরাষ্টের ডলারের উপর নির্ভর করে। মধ্যপ্রাচ্য তাদের মধ্যে অন্যতম। পণ্য দ্রব্য ও সম্পদের মুল্যের বুদবুদের (commodity and asset buble) কারণে যে সম্পদের সৃষ্টি হয় তা বিশ্বের দারিদ্র ও পরিবেশের ক্ষতি হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের জন্য বিনিয়োগ করা হয়নি বরং যে সকল ক্ষেত্রে এই সম্পদের বিনিয়োগ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে আনন্দ ভ্রমন, প্রমোদ জাহাজে সমুদ্রে ভ্রমন, প্রাসাদ নির্মাণ এবং অন্য অসংযত ক্ষেত্র যার মধ্যে আছে শুধুমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ইচ্ছাপূর্ণ স্বাপ্নিক ও রূপকথার মতো নির্মাণ প্রকল্প, উপসাগরীয় অঞ্চলে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি (যদিও সমুদ্র উপকূলের জলগতিবিদ্যার (hydrodynamics) সাথে এর আচরণ ভিন্ন গ্রহের জীবের মতো), অত্যন্ত দামী শিল্পকলা যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বর্ণের ভেড়া ও কেট মোস স্বর্ণের মূর্তি। এখন এসমস্ত ইচ্ছাপূর্ণ স্বাপ্নিক ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। পণ্য দ্রব্যের মূল্যের বুদবুদ বিস্ফোরণের মাধ্যমে একটি চক্রের শুরু হয়েছে যা মানুষকে ঋণ পরিশোধ করতে অসমর্থ করে এবং যা আবার বাজারকে অকার্যকর করে নতুন ঋন দেয়ার ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। এই নতুন ঋণ পুরাতন যে সমস্ত ঋণ পরিপক্ক হয়েছিল তা পরিশোধ করতে সাহায্য করতো।
বাংলাদেশের মতো ছোট অর্থনীতির দেশগুলো কোনভাবেই দীর্ঘমেয়াদী বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষতি বা বড় অর্থনীতর দেশগুলোর নেতিবাচক নীতি থেকে মুক্ত নয়, যার ফলস্বরূপ বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার একটি বড় অংশকে এরা প্রভাবিত করে। আর তাই জি-২০ এর মতো সম্মেলনে স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য এই ছোট দেশগুলোকে একসাথে খুব জোরালোভাবে যুক্তি তুলে ধরতে হবে এবং ঐ সমস্ত নীতি (শিথিল নীতি যা অবাধ তারল্য বৃদ্ধি করে বুদবুদের অনুকুল পরিবেশ তৈরি করে) বর্জন করতে হবে যা বৈশ্বিক অর্থনীতি ধ্বংসের কারণ (যেমন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় শিথিলতা এবং অপর্যাপ্ত নিয়মকানুন ও রক্ষণাবেক্ষণ)।
বৈশ্বিক অর্থনীতির ভারসাম্য এবং স্থিতিশীলতার নিরাপদ পথ খুব সহজ হবে যদি বৈশ্বিক তারল্য বৃদ্ধিটাকে বৈশ্বিক জিডিপি’র সাথে যে কোনভাবে একটা সংযোগ স্থাপন করা যায় বা বৈশ্বিক জিডিপি বৃদ্ধি বা হ্রাসের সাথে সাথে বিপরীত চক্র অনুসরণ করে তারল্যের অনুপ্রবেশ ও প্রত্যাহার নিয়ন্ত্রণ করবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) (সদস্য রাষ্ট্রের ভোটাদিকার ও তাদের অংশ যুক্তিযুক্তভাবে সাংশোধন ও সমতা আনয়নের পর)- কে এই ব্যবস্থার কর্ণধার হিসেবে ক্ষমতা প্রদান করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি সমস্ত বৈশ্বিক আর্থিক খাতের চূড়ায় অবস্থান করে নীতি গ্রহণ করবে। নতুন এই ব্যবস্থার জন্য (মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ স্বর্ণের উপর না হয়ে বৈশ্বিক জিডিপি’র উপর হবে) জনমত তৈরি করা খুব সহজ নয়। এ সম্পর্কে আমাদের এখনই জনমত তৈরি করার জন্য আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন।
বৈশ্বিক আর্থিক খাতের বেশিরভাগ স্থায়িত্ব আনা যায় কর্পোরেট অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের অতিরিক্ত শিথিলতাকে সংশোধনের মাধ্যমে। বর্তমান সমস্যার একটি কারণ হলো equity প্রধান বিনিয়োগ ব্যবস্থা হতে ঋণ প্রধান বিনিয়োগ ব্যবস্থায় যাওয়া, যার ফলে ঋনকৃত অর্থ পরিশোধ করতে না পারার জন্য বড় দেশগুলো আর্থিক খাত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সাধরণত equity অপেক্ষা ঋণ প্রধান বিনিয়োগকে বেশি পছন্দ করে, কেননা এর ফলে সে কিছু ট্যাক্স মওকুফ সুবিধা পায়। কিন্তু এর ফলাফল স্বরূপ শিল্পকারখানাগুলোর আর্থিক খাতের দুর্দশা বৃদ্ধি পায়, এমনকি তা শিল্পকরখানার ধ্বংস নিয়ে আসে যার প্রমাণ আমরা পেলাম বৈশ্বিক আর্থিক খাতে সৃষ্ট মন্দায়।
কিছু বছর যাবৎ সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেলসে অবস্থিত ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট আর্থিক খাত ও ব্যাংকের জন্য মূলধনের পর্যাপ্ততার আন্তর্জাতিক আদর্শ তৈরি করার কাজে নিয়োজিত আছে। আর্থিক খাতে পরিশুদ্ধ নীতি প্রণয়ন, অতিরিক্ত উদ্দেশ্য সাধনের সীমা নিয়ন্ত্রণ এবং ঋন ও equity এর ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্ব আদর্শ প্রণয়নের জন্য তাদের নিয়োজিত করা যেতে পারে। অবশেষে সম্পদ প্রধান বিনিয়োগ ব্যবস্থায় ট্যাক্সের পরিমাণ কমানো, ঋণ প্রধান ও সম্পদ প্রধান বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধার যে পার্থক্য রয়েছে তা কমিয়ে আনাই হবে একটি উত্তম পন্থা।
অর্থনীতিতে নোবলে পুরস্কার প্রাপ্ত (Jean Triohol) উল্লেখ করেছেন যে, বাজার ব্যবস্থাপনায় কিছু বিধি নিষেধ প্রয়োজন এবং অন্য এক গবেষনায় আরও অর্থনীতিবিদদের সাথে তিনি ব্যাংকিং খাতের নিয়ম কানুনকে সংশোধন করর প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করেছেন। তাই এখনই উত্তম সময়, এই লেখায় যে বিষয়গুলো উত্থাপন করা হয়েছে সেগুলো নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করা।