জিডিপি বৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ ও মুদ্রাস্ফিতি হ্রাসকরণ-এ দুটো উদ্দেশ্য কি সঙ্গতিপূর্ণ ?

ড. মির্জা আজিজুল হক
সাবেক উপদেষ্টা
তত্ত্বাবধায়ক সরকার

একটি দরিদ্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশ উচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবসময় প্রবৃদ্ধির সাথেই থাকতে চয়। বাংলাদেশের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল ২০১০-১১ হতে ১০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৬.৫ শতাংশ হতে ৮.০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। এ সময়ের মধ্যে মুদ্রাস্ফিতি ১০.৯ হতে ৬.০ শতাংশে নামিয়ে আনাও এ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল। এ নিবন্ধটির উদ্দেশ্য এই যে, এই দুটি উদ্দেশ্য যে পারস্পরিক সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় তা দেখানো।
মুদ্রাস্ফিতি নিয়ন্ত্রণ এবং প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত যুগপৎ করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান নীতিতে কিছু গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সাধারণভাবে মুদ্রাস্ফিতি বলতে আমরা বুঝি মূল্য সূচক বৃদ্ধি পাওয়া। সুতরাং যে নিয়ামকগুলো চহিদা ও যোগান এই দুই দিকে কাজ করছে সেগুলো এই মুদ্রাস্ফিতিকে প্রভাবিত করবে।
একটি অর্থনীতিতে মোট চহিদার ইতিবাচক উপাদানগুলো হলো ব্যক্তিগত ব্যয়, ব্যক্তিগত বিনিয়োগ, সরকারি ব্যয় এবং পণ্য ও সেবা রপ্তানি। বাংলাদেশর জিডিপি বৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভর করে এই উপাদানগুলে বৃদ্ধির উপর। দৃশ্যমান ও দ্রুত ব্যয়বহুল পণ্যের (যেমন মোটরগাড়ি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রয়ণ যন্ত্র এবং দামী ফ্ল্যাট) ব্যবহার/ভোগ বৃদ্ধি সত্ত্বেও বর্তমানে নিম্ন মাথা পিছু আয়ের কারণে ব্যক্তিগত ভোগের ব্যয় প্রধানত প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। উপরন্তু, অধিকাংশ মানুষ ভোগকে সমৃদ্ধির পরিমাপক হিসাব বিবেচনা করে।
জিডিপি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করার জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি খুবই প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগ এবং জিডিপির শতকরা অনুপাত ২৮। অন্যদিকে অর্থনীতিতে দ্রুত বর্ধনশীল দেশ যেমন চীন ও ভারতে এই আনুপাত যথাক্রমে ৪৫ ও ৩৬।
বাংলাদেশ অনভিপ্রেতভাবে কম সরকারি ব্যয়ের একটি দেশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক ২০১৪ অনুযায়ী দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার ১৩টি দেশের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় ও জিডিপি অনুপাতের তালিকায় বাংলাদেশের  অবস্থান নিচের দিক থেকে দ্বিতীয় যা অগ্রহণযোগ্য। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঘাটতি পরিকাঠামো (বিশেষ করে  পরিবহন, শক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি সম্পদ এবং গ্রামীণ উন্নয়ন) পূরণে সরকার যদি বিনিয়োগ ব্যয়  বৃদ্ধি নাও করে, বাংলাদেশের যে কোন সরকার সামাজিক সুরক্ষা নেটে ব্যয়, কল্যাণ সেবা এবং বিভিন্ন ভর্তুকি বৃদ্ধি করার জন্য প্রচন্ড চাপে থাকবে।
সমষ্টিগত চাহিদার শেষ ইতিবাচক উপাদান হলো রপ্তানি। সমষ্টিগত চাহিদা হ্রাস করার জন্য রপ্তানি কমনোর মাধ্যমে মূল্যকে স্থিতিশীল করার যে দৃষ্টিভঙ্গি তা সুস্পষ্টভাবেই অকার্যকর।
উপরের অনুচ্ছেদগুলোতে এটাই দেখানো হয়েছে যে, জিডিপি বৃদ্ধি যদি আমাদের প্রধান লক্ষ্য হয় তাহলে সমষ্টিগত চাহিদা সংকোচন নীতি গ্রহণ করার স্বাধীনতা তেমন নেই। ধরুন, সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অযৌক্তিক নীতি গ্রহণ করায়, প্রবৃদ্ধি কম হলো; তাহলে মূল্য স্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে সমষ্টিগত চাহিদা কমিয়ে আনলেই কি কাংখিত ফলাফল দিবে?
কমপক্ষে দুটি কারণে এই উদ্দেশ্য হতাশাজনক। প্রথমত, মুক্ত আমদানি নির্ভর অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যদ্রবের মূল্য নির্ধারিত হয় আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য দিয়ে। সামষ্টিক চাহিদার পরিবর্তন পণ্যদ্রব্যর মূল্যে অনুরূপ পরিবর্তন না এনে শুধু আমদানির মাত্রাতে অনুরূপ পরিবর্তন ঘটাবে। দ্বিতীয়ত, সামষ্টিক চাহিদাকে সংযত করার উদ্দেশ্যে মুদ্রা এবং বাজেট সংকোচন নীতি পণ্যের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ কমিয়ে এবং অবকাঠামোগত ব্যবস্থার অবনতি এনে অভ্যন্তরীণ বাজারে যোগানের উপর বিরুপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে। এখানে উল্লোখ্য যে, উৎপাদন সম্পর্কিত বেশিরভাগ পরিকাঠামো (জ্বালানি, পরিবহণ ইত্যাদি) বাংলাদেশ সরকার ব্যবস্থা করে। ২০০৮ সালে আইএমএফ এর সাথে বিভিন্ন বৈঠকে আমি জোরালোভাবে উপরের যুক্তি তুলে ধরি যার ফলে তারা সংকোচনমূলক চাহিদা পরিচালনার নীতি গ্রহণ করার জন্য চাপ প্রয়োগের নীতি হতে সরে আসে।
পণ্যদ্রব্য সরবরাহের জন্য উৎস দুটি- আমদানি এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে একটি ছোট দেশ হওয়ায়, আমদানি পণ্যের মূল্যের উপরে এর অভ্যন্তরীণ নীতি কোন ছোট প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে খাদ্য শস্য মুদ্রাস্ফিতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয় এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ যা Consumer Price Index (CPI) নির্ণয়ে প্রায় ৬০ ভাগ অবদান রখে। আমদানি নির্ভর অর্থনীতিতে, এটা প্রমান করা যায় যে, অভ্যন্তরীণ যোগানের পরিবর্তন (সরবরাহ রেখা চিত্র সরানোর মাধ্যমে) আমদানির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে, অভ্যন্তরীণ পণ্যদ্রব্যের মূল্যের উপর নয়। তবে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খুব কম সময়ের জন্য পণ্যের মূল্যের উপর নয়। তবে অভ্যন্তরীণ উৎাদন খুব কম সময়ের জন্য পণ্যের মূল্যে কিছু প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ ফসল তোলার পর দরিদ্র কৃষকরা খুব দ্রুত সময়ে কম মূল্যে তা বিক্রি করে দেবে, যেহেতু তাদের পণ্য বেশী দিন ধরে রাখার সামর্থ্য নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পণ্য দ্রব্যের মূল্য আমদানির মূল্যের কাছাকাছি চলে আসবে, যেহেতু আমাদের অর্থনীতি আমদানি নির্ভর। ধানের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে গত কয়েক বছর যাবৎ ধানের বাম্পার ফলন হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে যদি ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়। এমনকি সেক্ষেত্রেও রপ্তানি যদি সরকারিভাবে অনুমতি প্রাপ্ত না হয়, চোরাচালানের মাধ্যমে পণ্যদ্রব্যের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যের ব্যবধান কমে আসবে।
উপরের আলোচনা থেকে এটা পরিলক্ষিত হয় যে, জিডিপি বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার সময মুদ্রাস্ফিতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে অভ্যন্তরীণ যে নীতি গ্রহণ করা হয় তার মধ্যে মারাত্মক সীমাব্ধতা রয়েছে। এটা তাই আশ্চর্যনজনক নয় যে, বাংলাদেশ সরকার ধারাবাহিকভাবে সম্প্রসারণমূলক বাজেট নীতি এবং শিথিল মুদ্রা নীতি প্রয়োগ করে আসছে। আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য খাদ্য শস্য উৎপাদনে ভর্তুকি প্রদান করা উচিৎ; মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়।
যাই হোক, এটা আমরা খুব ভালোভাবে জানি, মুদ্রাস্ফিতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে দরিদ্রদের। সুতরাং জিডিপি প্রবৃদ্ধি যতদিন পর্যন্ত দারিদ্র কমিয়ে না নিয়ে আসে ততদিন পর্যন্ত সরকারকে সামাজিক সুরক্ষা বজায় রাখতে হবে অথবা প্রয়োজনে তা বৃদ্ধি করতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে প্রবৃদ্ধিকরণ কৌশলের পক্ষাবলম্বন করি। তবে এ কারণে সমষ্টিগতভাবে দরিদ্রদের উপর যে প্রভাব পড়বে তা সরকারি ব্যয় পুনর্বিন্যাস করে কমানো উচিৎ।

Share This