আইএমএফ SDR (Special Drawing Rights) বিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থার সংকট সমাধানে কতটুকু কার্যকর ?

জেডইউএম বাবর আলী
গবেষক
চিন্তার চাষ

আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল (আইএমএফ) হল একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। বর্তমান এর সদস্য দেশ ১৮৮টি। এটির প্রধান দায়িত্ব হলো ব্যবসা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উৎসাহিতকরা এবং আর্থিক খাতের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য অনুসারে আইএমএফ ঐ সমস্ত দেশকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করে, যাদের আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে ঋণাত্মক প্রবণতা (আমদানি বেশি রপ্তানি কম) আছে। আইএমএফ প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৪৪ সালে, ব্রেটন উডস সম্মেলনে। এটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় ১৯৪৫ সালে। আইএমএফ (Special Drawing Rights (SDR)) কে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিনিময় মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে। শুরুর দিকে (SDR) এর মূল্য ছিল ০.৮৮৮৬৭১ গ্রাম স্বর্ণের সমান যা আবার এক ডলার এর সমান। ১৯৭১ সালের ১৫ আগষ্ট যখন মার্কিন ডলারের সাথে স্বর্ণের সম্পর্ক সামরিয়কভাবে স্থগিত করা হয় তখন ব্রেটন উডস চুক্তি ভেঙ্গে পড়ে। যার ফলে (SDR) কে পূনরায় সজ্ঞায়িত করা হয এবং সংযুক্ত করা হয় একের অধিক মূদ্রার ঝুড়ির সাথে। বর্তমানে (SDR) এর মুল ঝড়িতে চারটি দেশের মূদ্রা রয়েছে। সেগুলা হলো মার্কিন ডলার, ইউরো, গ্রেট ব্রিটেন এর পাউন্ড স্টার্লিন এবং জাপানী ইয়েন। এই সবগুলো যেহেতু ফিয়াট মুদ্রা (কাগজের মুদ্রা যার মানের সাথে স্বর্ণের বা পণ্যদ্রব্যের সম্পর্ক নাই) সেহেতু (SDR) একটি ফিয়াট মূদ্রা । এর মূল্য কোনও পন্যদ্রব্য এর সাথে সংযুক্ত না থাকায় বিভিন্ন কাগজের মুদ্রার মান যে সমস্ত বিষয়ের উপর নির্ভর করে (SDR) এর মানও ঐ সমস্ত বিষয়ের উপর নির্ভর করবে। আইএমএফ এর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সদস্য রাষ্ট্রের ভোটে । আইএমএফ এ ভোটের ক্ষমতা সব দেশের সমান নয়। এর কোন মৌলিক বিষয় পরিবর্তন করতে চাইলে ৮৫% ভোট দরকার হবে। অর্থাৎ যদি কোন রাষ্ট্রের ভোট ১৫% এর উপর হয় সেই রাষ্ট্র আইএমএফ এর মৌলিক পরিবর্তনকে রহিত করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় তার ভোটের ক্ষমতা ১৫% এর উপরে রেখেছে। আইএমএফ এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো এখন দুইভাগে বিভক্ত। উন্নত দেশ যারা ঋণ দেয় এবং দরিদ্র দেশ যারা ঋণ গ্রহণ করে। অনুন্নত দরিদ্র দেশগুলো অভিযাগ করছে যে আইএমএফ একটি অগণতান্ত্রিক সংস্থা। যার কারণে ঋণগ্রস্থ দেশর স্বার্থ এই সংস্থার নীতিতে প্রতিফলিত হয় না। অন্যদিকে স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে উন্নত দেশগুলো সম্পূর্ণরূপে গণতান্ত্রিক পন্থায় যেতে চাচ্ছে না।

২০০৭ সালে গৃহায়ন বুঁদবুঁদ (Housing Buble) বিস্ফোরণ হওয়ার পর যে মন্দার সৃষ্টি হয় তখন থেকেই (SDR) কে বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করার জন্য প্রস্তাব উঠে। চীন তার ইয়েনকে (SDR) এর মূদ্রার ঝুড়িতে ঢোকানোর জন্য আনেকদিন যাবৎ প্রস্তাব করে আসছে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। যদি কোন দেশের মূদ্রাকে রিজার্ভ মূদ্রা করা হয়, সেই মূদ্রা এমন এক রূপ নেয় যার  কারণে পৃথিবীর অন্য সব মূদ্রার স্থায়িত্ব ও মান এর উপর নির্ভর করে। এই মূদ্রা অন্য সব মূদ্রার উপর অগ্রাধিকার পায়। রিজার্ভ মূদ্রা স্বয়ংক্রিয় ভাবে সব দেশে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং যে দেশের মূদ্রা রিজার্ভ মূদ্রার অবস্থান পায়, সে দেশ দীর্ঘ কালধরে শিথিল মূদ্রা নীতি প্রয়োগ করতে পারে। গত ৫০ বছর ধরে ইউএস ও তার নিকটতম বন্ধু রাষ্ট্রগুলি অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বাজারে মূদ্রা প্রবাহ বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। সাধারণত কোন দেশের ঋণ ও জিডিপির অনুপাত যদি বেশি হয় তাহলে সে দেশের জন্য ঋণ নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও আরও চার পাঁচটি দেশের ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ১০০% এর কাছাকাছি বা এর চেয়ে বেশি হওয়া সত্ত্বেও বাজার হতে খুব কম সুদে ঋণ নেয়া তাদের জন্য কোন সমস্যাই না। তার এক মাত্র কারণ ঐ দেশগুলোর মূদ্রা রিজার্ভ মূদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখন যদি (SDR) কে রিজার্ভ মূদ্রা করা হয় তাহলে এর ঝুড়িতে যে সমস্ত মূদ্রা থাকবে সেই দেশগুলো অন্য বৈষয়িক অর্থনীতি থেকে কিছু সুবিধা পাবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইউএসএ’র একক আধিপত্য কিছুটা হ্রাস পাবে।

এখন আমরা গত তিনশত বছরের ক্রেডিট, মূদ্রা নীতি এবং এর সাথে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও একক মূদ্রা জোন ইউরোপ এর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বুঝতে পারব এই ফিয়াট (SDR) মূদ্রা সত্যিকার ভাবেই দরিদ্র ও ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রগুলোকে কোন সুবিধা দিবে কি না?

James Rikards তার বিখ্যাত বই Currency War এ উল্লেখ করেছেন Keyensian একবার বলেছিলেন প্রতিদশ লক্ষ্যে মাত্র একজন ব্যক্তি মূদ্রা অবমূল্যায়ন সম্পর্কে বুঝে আর এই কথার সূত্র ধরে James Rikards বলেছেন প্রতি এক কোটি লোকে মাত্র একজন আইএমএফ কিভাবে কাজ করে তা বুঝে।

যদি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা সম্পর্কে মানুষের ধারণা অস্পষ্ট হয় তাহলে কিভাবে আশা করা যায় যে আইএমএফ এর কাছ থেকে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো তাদের অধিকার আদায় করে নিতে পারবে? কাগজের মূদ্রা কারো একক নির্দেশে তৈরি হতে পারে। স্বর্ণের মূদ্রা কারো পক্ষেই শূন্য থেকে তৈরি করা সম্ভব নয়। আর স্বর্ণ মূদ্রা তৈরি করতে শ্রম লাগে। শ্রম সম্পদ তৈরি করে। যখন এটা (স্বর্ণ) বাজারে আসে একজন সাধারণ মানুষ তার সাধারন জ্ঞান ব্যবহার করে তাতে সহজে আসল নকল আলাদা করতে পারে।

ব্রেটন উডস সমঝোতা অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র প্রতি ৩৫ মার্কিন ডলারের জন্য এক আউন্স স্বর্ণ দিতে বাধ্য থাকবে মর্মে অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রগুলো যখন আবস্কার করলো যে যুক্তরাষ্ট্র তার গোল্ড রিজার্ভের চেয়ে বেশি পরিমাণ ডলার ছাপাচ্ছে তখন কিছু রাষ্ট্র তাদের কাছ সংরক্ষিত ডলারের বিনিময়ে স্বর্ণ মূদ্রা ফেরত চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। কিন্তু ইউএস হঠাৎ করে ১৯৭১ সালের ১৫ আগষ্ট ডলারের সাথে স্বর্ণের সম্পর্ক সাময়িকভাবে রহিত করলো। সেই সাময়িক স্থগিত এখনও চলছে। কিন্তু কোন রাষ্ট্রই তখন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস করেনি তার সামরিক শক্তির কারণে। যেখানে কেটি রাষ্ট্র একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসরণে বাধ্য সেখানে তারপরেও রাষ্ট্রটি তা করতে অস্বীকার করেছে তাই ভবিষ্যতে যে কোন রাষ্ট্র তার সামরিক শক্তির দাপটে আবার তার অঙ্গীকার অস্বীকার করতে পারে। তাই ভবিষ্যতে কোন রাষ্ট্র সামরিক ক্ষমতার দাপটে এ ধরণের কাজ করবেনা ঐ নিশ্চয়তা কে দিবে? আমরা যদি জাতিসংঘের দিকে তাকাই সেখানে দেখবো শক্তিশালী রাষ্ট্র ছোট রাষ্ট্রগুলোকে আক্রমণ করছে কোন নিয়ম নীতি না মেনে। আমরা যদি একক মূদ্রা ইউরোর দিকে তাকাই তাহলে দেখবো সেখানে সবার সমান ভোট থাকার পরও ক্ষুদ্র ও ছোট রাষ্ট্রগুলো বড় রাষ্ট্রগুলো দ্বারা রাষ্ট্রীয় মারপ্যাচে মার খাচ্ছেই। আমরা যদি ধরেও নেই যে আইএমএফ সবাইকে সমান ভোটের অধিকার দিবে তাতেও কি সমস্যার সমাধান হবে? আমার মনে হয় না। আমরা যদি আমেরিকার জনগনের দিকে তাকাই, সবারই একই ভোট তারপরও তাদের ধনী এবং দরিদ্রের ব্যবধান পহাড়সম। এই সবগুলো সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় SDR কে গোল্ড, সিলভার বা অন্য কোন পণ্যদ্রব্যের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। এ ফলে SDR এর মান নির্ণয় করতে কোন রকম লুকাইত জটিল সূত্রের প্রয়োজন হবেনা। একক কোন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব না করার কারণে আইএমএফকে তারল্য বৃদ্ধি করার ক্ষমতা প্রাদান করা সমীচীন হবেনা। তাই প্রতি বছর গোল্ডের যোগান বাড়ানো তেমন কোন বাধ্যবাধকতা থাকবে না।

প্রতি বছর বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে একবার গোল্ডের সত্যিকারের স্থানান্তর করতে হবে। যাতে এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের সাথে প্রতারণা করলে খুব সহজেই নির্ণয় করা যায়। দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যা হচ্ছে যদি এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রকে সাহয্য করে তখন সে কিভাবে লাভ নিবে? দাতা রাষ্ট্র যদি গ্রহীতা রাষ্ট্রকে ঋণ হিসেবে ১০০ SDR দেয় তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সেকি ১০০ SDR ই নিবে নাকি অন্য কোন চুক্তি করবে। সুদ সিস্টেমে গেলে মার্কেটে সবসময SDR এর চাহিদা বাড়তে থাকে যদিও এরিস্টটল সুদ কে নিষেধ করেছে এবং গাণিতিকভাবে এটি প্রমাণ করা যায় যে সুদ অর্থ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটায়। সব চেয়ে ভালো হয যদি ঋণ গ্রহীতা এবং ঋণ দাতা রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের সাথে মুনাফার চুক্তি করে। কিন্তু যদি ঋণদাতা রাষ্ট্র লোকসানকে গ্রহণ করতে না চায় সেক্ষেত্রে সে অতিরিক্ত যে লাভ দাবি করবে সেটা তাকে ঋণ গ্রহীতা রাষ্ট্রের মূদ্রায় নিতে হবে। অর্থাৎ যে ১০০ SDR সে ঋণ দিযেছে তা ফেরতের সময় ১০০ SDR নিবে সাথে সে ঋণ গ্রহীতা রাষ্ট্রের মূদ্রাতে চুক্তি অনুসারে তার প্রাপ্য পাবে। এক্ষেত্রে সারা বিশ্বে SDR এর বৃদ্ধির কোন চাপ থাকবে না। অর্থাৎ যদি কোন নতুন স্বর্ণ বাজারে নাও আসে তাতে কোন সমস্যা নেই। অবশেষে এটুকু বলতে পারি, ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো যদি সম্মিলিতভাবে এ ধরনের চুক্তিতে না আসতে পারে তাহলে আমরা এবং আগামী প্রজন্ম কাগজ অথবা ইলেকট্রনিক মুদ্রার দাস হব।

তথ্যের উৎস:

১.  http://planningcommission.nic.in/abouutus/speech/spemsa/msa 019.pdf(February, 2015)
২. http://www.sirudorealty.com/assets/PDFs/Special-Drawwing-Rights.pdf(February,2015)
৩.  http://en.wikipedia.org/wiki/Special_drawing_rights(February, 2015)
৪.  https://www.princeton.edu/-ies/IES_Essays/E128.pdf(February, 2015)
৫.  https://www.princeton.edu/-pcglobal/conferences/IES/parers/broz_bnlomberg_F1030_1.pdf(February, 2015)
৬.  Currency war by James Rickards
৭.  Death of Money by James Rickards
৮.  The Mystery of Banking by Murray N. Rothbard

Share This