ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ
অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ
অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
একটি দেশের সরকার জনগনের নিকট হতে কর গ্রহণ করে তা রাষ্ট্র পরিচালনা ও অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করে। বিষয়টি বাজেট ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের সামনে আসে। এই কর গ্রহণ প্রক্রিয়া বিভিন্ন আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় একজন মানুষ কোন পণ্য বা দ্রব্য উৎপাদন করলে বা তাতে কোন মূল্য সংযোজন ঘটালে অথবা দুজন ব্যক্তির মধ্যে সম্পদের স্থানান্তর ঘটলে আমরা এগুলোকে অর্থনেতিক কর্মকান্ডের আওতায় ফেলি। আর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডসমূহ যখন আইনী কাঠামোর আওতায় সরকারের নিকট দৃশ্যমান থাকে তখন সেগুলো হতে উপাত্ত সংগ্রহ করে সরকার জিডিপি (gross domestic product) গণনা করে থাকে। কিন্তু সরকারের নিকট অর্থনীতির যে দালিলিক চিত্র থাকে, দেখা যায় একটি দেশের প্রকৃত অর্থনীতি তার কয়েকগুণ। সরকারি হিসাবের বাইরের এই অর্থনীতিকে বলা হয় অনানুষ্ঠানিক (informal) অর্থনীতি। সংজ্ঞায়নের বিচারে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি হচ্ছে বাণিজ্য ব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক বিনিময় যা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রাভিত্তিক বিনিময়ের বাইরে ব্যবহৃত হয়।
পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই এই অনানুষ্ঠানিক (informal) অর্থনীতির অনুশীলন করে। পণ্য ও সেবা বিনিময়, পারস্পারিক সহযোগিতা, নিম্ন মানের চাকুরী, রাস্তায় পণ্য বিক্রয় এবং অন্যান্য সরাসরি পণ্য বিক্রয় কার্যক্রম এই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে যা আয় হয় তার তথ্য সাধারণত কর গ্রহনণর জন্য সংরক্ষণ করা হয়না এবং তা জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয়না। উন্নয়নশীর দেশগুলোতে অকৃষি কর্মসংস্থানের পঞ্চাশ থেকে পচাত্তর শতাংশই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির আওতামুক্ত। অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান (informal emplyment) এর বৈশিষ্ট্য হলো: ১. মজুরী প্রদান না করার ক্ষেত্রে শ্রমিকের সুরক্ষার অভাব, ২. বাধ্যতামূলক ওভারটাইম এবং অতিরিক্ত শিফট, ৩. ক্ষতিপূরণ বা নোটিশ না দিয়ে বরখাস্ত, ৪. অনিরাপদ কাজের পরিবেশ এবং ৫. সামাজিক সুবিধা যেমন: পেনশন, স্বাস্থ্য বীমা ইত্যাদির অনুপস্থিতি। অভিবাসী, নারী এবং অন্যান্য দুর্বল, গোষ্ঠী যারা অন্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং যাদের আর তেমন কোন উপায় নেই তারাই নিম্ন মানের অনানুষ্ঠানিক কর্মস্থানে প্রবেশ করে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) ২০০২ সালের জুনে মর্যাদাসম্পন্ন কাজ এবং অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম কনরফারেন্স আয়োজন করে যাতে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে শ্রমিকের স্বার্থ চিহ্নিত করার প্রতি আহ্বান জানানো হয় এবং তাদের সম্মানজনক কাজের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়।
অনানুষ্ঠানিক খাত শ্রম বাজারে একটা বড় অংশ দখল করে আছে। একদিকে ব্যক্তি এবং পরিবারের আচরণ বৈশিষ্ট্যের দ্বারা অনানুষ্ঠানিক খাত গঠিত হয় যেখানে আয়ের সুযোগ সমূহ কমে যায়। অন্যদিকে উদ্যোক্তাদের রাষ্ট্রের নিযন্ত্রণ থেকে বের হওার চিরায়ত অভ্যাসের ফল হচ্ছে এই অনানুষ্ঠানিক খাত। এই দুই ধরনের অনানুষ্ঠানিক খাতের কার্যক্রম নিম্নরূপ:
১. জীবনধারনের কার্যক্রম (কৌশলের সাথে খাপ খাওয়ানো)। এর মধ্যে রয়েছে অস্থায়ী চাকরী, অবৈতনিক চাকরি, শুধুমাত্র জীবনধারণের জন্য কৃষিকাজ এবং একাধিক চাকরি গ্রহণ।
২. অপ্রদর্শিত আয়ের কৌশল। একে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ক. অপ্রদর্শিত ব্যবসায়ীক কার্যক্রম যার মধ্যে রয়েছে কর ফাঁকি, শ্রম আইন এবং সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক আইন অমান্য, নিবন্ধন না করা ইত্যাদি। খ. গুপ্ত কার্যক্রম যার মধ্যে রয়েছে অপরাধ, দুর্নীতি ইত্যাদি।
অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক খাত অর্থনীতিতে একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত ভূমিকা পালন করে। এটি একদিকে কর্মসংস্থান যোগায় এবং বেকারত্ব দূর করে উন্নয়ন ঘটায় কিন্তু অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের চাকরিতে মজুরী কম। এটি অর্থনৈতিক উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করে কিন্তু রাষ্ট্র কর প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হয়। এটা দারিদ্র দূর করে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এখাতে শ্রম নিরাপত্তা কম। অনানুষ্ঠানিক খাতের আকৃতি উচ্চ আয়ের দেশে চার থেকে ছয় শতাংশ আর নিম্ন আয়ের দেশে পঞ্চাশ শতাংশের অধিক। অর্থনীতির নিম্নগামীতা বা অন্তবর্তীকালীন অবস্থায় অনানুষ্ঠনিক অর্থনীতির আকৃতি এবং ভূমিকা বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ILO ১৯৭২ সালে অনানুষ্ঠানিক খাতের ধারণা প্রবর্তন করে ILO তার কেনিয়া মিশন প্রতিবেদনে অনানুষ্ঠানিক খাতকে সংজ্ঞায়িত করে যে এটা হচেছ কাজ করর পদ্ধতি যার বৈশিষ্ট্য ক. সহজ প্রবেশ্যতা, খ. নিজস্ব উৎসের উপর নির্ভরতা, গ. পারিবারিক মালিকানা, ঘ. ক্ষুদ্র পরিসরে কার্যক্রম, ঙ. আনুষ্ঠানিক খাতের বাইরে থেকে দক্ষতা অর্জন এবং চ. অনিয়ন্ত্রিত ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার। সেসময় থেকেই বিভিন্ন লেখক ও ILO নিজেই অনানুষ্ঠানিকখাতকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ১৯৯৯ সালে ILO/ ICFTU এর অনানুষ্ঠানিক খাতের উপর আয়োজিত আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামে প্রস্তাব করা হয যে, অনানুষ্ঠানিক খাতের চালিকা শক্তিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
ক. ক্ষুদ্র ব্যবসা / উদ্যোগের মালিক- শ্রমিক
খ. এক ব্যক্তি পরিচালিত ব্যবসা যেকানে মালিক নিজেই শ্রম দেয় এবং কোন শ্রমিক নেই অথবা থাকলেও অবৈতনিক (সাধারণত পারিবারিক সদস্য অথবা শিক্ষানবিস)
গ. নির্ভরশীল শ্রমিক (বেতনভুক্ত অথবা অবৈতনিক) যার মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিয়োজিত শ্রমিক, অবৈতনিক পারিবারিক সদস্য, শিক্ষানবিস, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক ও গৃহকর্মী
অনানুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক খাতকে সংজ্ঞায়নের ভিত্তিতে পৃথক করা একটু কঠিন। একজন ক্ষুদ্র বিক্রেতা, যিনি রাস্তায় পণ্য বিক্রি করেন তার ব্যবসা অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিক মধ্যে পড়বে। আবার তিনি যদি তার প্রতিষ্ঠানকে রেজিস্ট্রেশন করান এবং যার ফলে তিনি সরকারকে কর প্রদান করেন তাহলে তার এ অর্থনৈতিক কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হবে। পুঁজিবাদ বিকাশের পূর্বে অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই ছিল অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি। সামাজিক অর্থনীতির স্বভাবিক বিকাশে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ অতটা তৃণমূল পর্যায়ে ছিলনা। অর্থনৈতিক কমর্ককান্ড ছিল ঐতিহ্যভিত্তিক ও পরিবার কেন্দ্রিক। পারিবারিকভাবে গোয়ালা, জেলে, কামার, কুমার, কৃষক, ধোপা ইত্যাদি পেশাজীবী ছিল যেখানে গোয়ালা ছেলে গোয়ালা, কামারের ছেলে কামার এবং কৃষকের ছেলে কৃষক হতো। বাজার পেশা নির্বাচনে তেমন কোন ভূমিকা রাখতনা। পরবর্তীতে শিল্পায়নের যুগে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হওয়ায় মানুষ পৈত্রিক পেশা ছেড়ে ছলে আসে শিল্প কারখানায়। অনেকে সরকারী চাকুরীতে যোগ দেয়। ফলে তাদের আয় সরকারের গণনার মধ্যে প্রবেশ করে। এভাবে মানুষ ধীরে ধীরে আইনী কাঠামোতে প্রবেশ করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করে এবং আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটায়। একটি দেশের আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির আকার যত বেশি সে দেশের সরকার তত বেশি আয় করবে এবং মানুষ তত বেশি অর্থনৈতিকভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে সরকারের কর প্রাপ্তি কম ঘটে তবে মানুষের অর্থনীতিতে কম থাকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ।