পোশাক শিল্পের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায় (মূল প্রবন্ধ)

ড. শফিক উজ জামান
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
এবং পরিচালক, অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ভূমিকা

রপ্তানি বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জিডিপিতে অবদান বৃদ্ধি যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান অপরিসীম। স্বাধীনতার মাত্র ৭ বছর পরে প্রায় শুণ্য থেকে শুরু করে মাত্র ১২ বছরের মধ্যেই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছা এবং দশ লাখের অধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান করা এ শিল্পের জন্য অনেকটা কল্পনাতীত ছিল। এই শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শ্রমিকের সিংহ ভাগ নারী শ্রমিক যার অধিকাংশ এসেছে গ্রাম এলাকার হত দরিদ্র পরিবার থেকে। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বাংলাদেশ ছিল কৃষি নির্ভর প্রান্তিক অর্থনীতির দেশ। কেবলমাত্র পাটজাত দ্রব্য ও কাঁচামাল ছাড়া কোন রপ্তানি পণ্য ছিল না। তেমন অবস্থা থেকে তিলে তিলে গড়ে ওঠা পোশাক শিল্প আজ বাংলাদেশকে বিশ্বে নতুন ভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। গত ৩৫ বছরের চরাই উৎরাই পার হয়ে আজ দেশের পোশাক খাতে আবির্ভূত হয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ এবং অস্থিতিশীল বিশ্ব বাজার। এসব কিছুই দেশের অর্থনীতির জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্প খাতকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে। একই সাথে এ শিল্পের সম্ভবনাও কম নয়। আলোচ্য প্রবন্ধে এই শিল্পের আবির্ভাব, উদ্যোক্তাদের বৈশিষ্ট্য এবং শিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনার দিক তুলে ধরা হয়েছে।

পোশাক শিল্পের বিকাশ ও অর্থনীতিতে এই শিল্পের গুরুত্ব

গত শতাব্দীর ৭০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত রপ্তানি খাতে পোশাক শিল্পের নাম ছিল না। ১৯৭৬ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস এবং জুয়েল গার্মেন্টস পোশাক শিল্পে যোগ দেয়। রিয়াজ গার্মেন্টস ষাটের দশকেই পোশাক শিল্প কারখানা গড়ে তোলে তবে তা ছিল স্থানীয় বাজার ভিত্তিক। সর্বপ্রথম ১৯৭৭ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস ফ্রান্সে পোশাক রপ্তাান শুরু করে। ১৯৭৮ সালে নুরুল কাদের, একজন সরকারী আমলা ও মুক্তিযোদ্ধা, কোরিয়ার দাইয়েয়ু কোম্পানির সহায়তায় পোশাক রপ্তানি শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে আরও কয়েকটি ফার্ম এগিয়ে আসে। তবে ১৯৮০-৮১ সালের আগ পর্যন্ত এই শিল্পের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।

১৯৭৭-৭৮ সালে ২২টি ফার্ম পোশাক রপ্তানি করে ৪০ হাজার ডলার আয় করে এবং এর দু’বছর পর থেকেই রপ্তানি আয় ও ফার্মের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। ১৯৭৩-৭৪ সালে রপ্তানি আয়ে নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল পাট ও পাটজাত দ্রব্যের। তবে ক্রমেই পোশাক শিল্পের বৃদ্ধি রপ্তানি আয় দখল করে নেয়। তবে ১৯৮৪-৮৫ সাল পর্যন্ত রপ্তানি খাতে পাট ও পাটজাত খাতের অংশ ছিল অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৫৭.৮৬ শতাংশ।

ছক-১: রপ্তানিতে পাট ও পোশাকের অবদান।

অর্থবছর

পাট ও পাটজাত দব্য পোশাক
১৯৭৩-৭৪ ৮৬.৭৩
১৯৮৪-৮৫ ৫৭.৮৬ ১৬.০৫
২০০৩-০৪ ৪.২ ৭৪.৪০
২০০৯-১০ ৪.৮৬ ৭৭.১২
২০১৩-১৪ ৩.৮৫ ৮১.১৭

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা

এর পরের বছর থেকেই পোশাক রপ্তানি প্রধান খাত হিসেবে আবির্ভূত হয়। ২০০০ সাল থেকেই পোশাক রপ্তানি মোট রপ্তানির তিন-চতুর্থাংশ দখল করে। অপরদিকে রপ্তানিতে পাট খাত ৫ শতাংশের নীচে নেমে যায়। বর্তমানে পোশাক রপ্তানির (ওভেন এবং নিটিং খাতের একত্রে) মোট রপ্তানীতে ৮১.১৭ শতাংশ (২০১৩-১৪ অর্থ বছর) অবদান রয়েছে (ছক-১)।

১৯৮১-৮২ সালে মোট পোশাক শ্রমিকের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ হাজার। আজ তার পরিমান ৪০ লক্ষ এবং এর ৮০ শতাংশই মহিলা শ্রমিক। ১৯৯৫-৯৬ সালে সমগ্র শ্রম শক্তিতে মহিলা শ্রমিকের অংশ ছিল ৩৮ শতাংশ তার মধ্যে ৭ শতাংশ ছিল ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে। বর্তমানে সমগ্র ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নিয়োজিত মহিলা শ্রমিকের পরিমাণ ৪০ শতাংশ।

পোশাক রপ্তানির কারনেই আমদানি-রপ্তানি ব্যবধান হ্রাস পেয়েছে এবং বর্তমান রপ্তানি আয় দিয়ে ৮০ শতাংশ আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তেমনিভাবে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বৃদ্ধিতেও পোশাক শিল্পের অবদান অপরিসীম। পোশাক শিল্পের বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়ে উঠেছে অনেক সহযোগী শিল্প ব্যবস্থা এবং যোগাযোগ। সামগ্রিকভাবে এ শিল্পের সাথে জড়িত ৪০ লক্ষ শ্রমিক এবং সহযোগী  শিল্প ও সেবা খাতের শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ফলে প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষের জীবিকার সংস্থান হয়েছে যা দারিদ্র বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সত্তর দশকে বাংলাদেশ কেবলমাত্র কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল আর বর্তমানে রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই শিল্প পণ্য যা উন্নয়নশীল দেশে অনন্য।

বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে উদ্যোক্তা শ্রেণীর আবির্ভাব

কৃষি নির্ভর অর্থনীতিকে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে রূপান্তরের মাধ্যমে সাধারনতঃ শিল্পায়নের শুরু হয়। তবে দেশ কাল ভেদে এর ভিন্নতাও লক্ষনীয়। শিল্পায়নের মাধ্যমেই অর্থনীতির অপরাপর খাত, উপখাতের বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়। শিল্পায়ন ছাড়া কোন দেশ উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল।  আমরা উন্নত দেশ না বলে হামেশাই বলি শিল্পোন্নত দেশ। তাই দেশের অগ্রগতির জন্য শিল্পোন্নয়ন অপরিহার্য। আর বাংলাদেশের মত বিপুল ঘনবসতিপূর্ণ দেশে শিল্পোন্নয়নের গুরুত্ব আরও বেশি। কিন্তু শিল্পোন্নয়নের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন উদ্যোক্তা শ্রেণীর সৃষ্টি। নতুন পণ্য ও সেবার সৃষ্টি, গুণগত মান বৃদ্ধি বা যে কোন ধারণার উদ্ভাবনই হলো উদ্যোগ বা শিল্পদ্যোগ। আর যিনি এই উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাকেই সাধানত আমরা উদ্যোক্তা বলি। আরও বিস্তারিত বলতে গেলে শুধু শিল্পক্ষেত্রে নয়, উদ্যোক্তা নামের সাথে সম্পদ সৃষ্টির সম্পর্ক আছে। সম্পদ আপনা আপনিই সৃষ্টি হয় না। প্রকৃতি থেকে অঢেল সম্পদ পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু এই প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদকেও ব্যবহারযোগ্য সম্পদে পরিণত করতে প্রয়োজন গবেষণা, আবিষ্কার, উন্নতি ও উদ্ভাবন। গবেষণা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে জ্ঞান ও নতুন পদ্ধতি সৃষ্টি হয়। এই জ্ঞান ও নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে ক্রমান্বয়ে উদ্ভাবনের মাধ্যমে তা উৎপাদন কাজে প্রয়োগ করা হয়। এসব কিছু মূলত অর্থনৈতিক কার্যকলাপের অন্তর্ভূক্ত। সম্পদ সৃষ্টির এই পরস্পর সম্পর্কীত গবেষণা, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, উন্নয়ন ও উদ্ভাবনের সমগ্র প্রক্রিয়াটিই যারা সম্পাদন করেন তারাই উদ্যোক্তা। নতুন নতুন পণ্য ও পদ্ধতি আবিষ্কারের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বহন করেন, শ্রমিক অসন্তোষ মোকাবেলায় শান্তিপূর্ণ সমাধানে উদ্যোগ গ্রহন করেন এবং শ্রমিককে উৎপাদনশীল করার জন্য উন্নত প্রযু্িক্তসহ জটিল কলাকৌশল শেখানোর প্রশিক্ষণ দেয়া এসব কিছুই উদ্যোক্তার কর্মকৌশলের আওতাধীন। এই উদ্যোক্তা বা ঊহঃৎবঢ়ৎবহবঁৎ শব্দটি সুম্পিটরের দেয়া।

দেশের শিল্পায়ন তথা উন্নয়ন মূলত এই উদ্যোক্তার যোগানের উপর নির্ভরশীল। শিল্প বিপ্লবের ফলে ব্রিটেনের উন্নয়নে বেশি অবদান ছিল উদ্যোক্তা গোষ্ঠীর। শুধু ব্রিটেনে নয় বিশ্বের শিল্পোন্নত সকল দেশের উন্নয়নের পশ্চাতে এই শিল্পোদ্যোক্তা গোষ্ঠী সর্বাধিক অবদান রেখেছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল কৃষিভিত্তিক, শিল্পায়নে অর্নগ্রসর। শিল্পোদ্যোক্তা বলতে যা বুঝায় তা ছিল প্রায় অনুúস্থিত। ঐতিহাসিক কারনেই বাংলাদেশ শিল্পে অনগ্রসর। উল্লেখ্য যে, প্রাক বৃটিশ আমলে বাংলাদেশ শিল্পে সমৃদ্ধশীল অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল। উপনিবেশিক আমলে ঐতিহ্যবাহী শিল্প ধ্বংস করে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হয় ইউরোপ এবং উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠা শিল্পাঞ্চলের কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশ হিসেবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ উপনিবেশিক আমলের বৈষম্য অবসানের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠির আচরন ছিল উপনিবেশিক আমলের অনুরুপ। ষাটের দশকে আন্দোলনের চাপে কিছু কিছু সুবিধা দেয়ায় কিছু ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প গড়ে উঠলেও শিল্প ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী প্রাধান্য অটুট থাকে।

স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ১৯৭২ সালে কৃষিই ছিল অর্থনীতির প্রধান খাত। জিডিপিতে শিল্পের অবদান ছিল ১৩ শতাংশ তার মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান ছিল ৯ শতাংশ। জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্পের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই প্রথম পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনায় শিল্পখাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। স্থানীয় কাঁচামাল ভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ও আত্মনির্ভরশীল শিল্পের গতি ত্বরান্বিত করতে আমদানি বিকল্পায়ন কৌশল গ্রহণ করা হয়। তবে নামে আমদানি প্রতিস্থাপন হলেও শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং মূলধনী দ্রব্যের প্রায় পুরোটাই ছিল আমদানি নির্ভর। এই আমদানি দ্রব্যের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংস্থানের একমাত্র উপায় ছিল প্রাথমিক পণ্য রপ্তানি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাথমিক পণ্যের মূল্য হ্রাসের কারণে বাণিজ্য ভারসাম্য ক্রমশঃই বাংলাদেশের বিপক্ষে চলে যায়। ফলে আমদানি প্রতিস্থাপন কৌশল কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। তা সত্ত্বেও স্থানীয় কাঁচামাল ভিত্তিক বেশ কিছু বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পকারখানা স্থাপিত হয়। ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তার আড়াই মাস পরে জাতীয় চার নেতার নৃশংস হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয় তার সাথে সাথে শিল্প নীতি কৌশলেও পরিবর্তন ঘটে।

১৯৮২ সালে নয়া শিল্পনীতি গৃহীত হয়। এই নীতিমালায় বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল নির্দেশিত কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচীর অধীনে ১৯৭৩ সালে গৃহীত আমদানি প্রতিস্থাপন কৌশলের পরিবর্তে রপ্তানিমুখী কৌশল গ্রহন করা হয়। এই নতুন নীতিমালায় রাষ্ট্রীয় খাত সংকোচন করে ব্যাক্তিখাতকে উৎসাহিত করা হয় যা আজও অব্যাহত আছে।

উল্লেখ্য যে, বৃটিশ ভারতে শেষের দিকে বস্ত্র শিল্পের পাশাপাশি পাট শিল্প গড়ে ওঠে এবং বিগত শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরই ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্প হিসেবে কোলকাতার আশেপাশে গড়ে ওঠা। এই শিল্পের তিন-চতুথাংশ কাঁচামাল সরবরাহ হয় পূর্ব বাংলা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ থেকে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় স্থাপিত ১০৬ টি পাট কলের একটিও বাংলাদেশের ভাগে পড়েনি। ৯টি বৃহৎ বস্ত্র কারখানা ছাড়া সবই ছিল হস্তশিল্প স্তরের। এ সময় শিল্প ও ব্যবসার বৃহৎ অংশের মালিক ছিল হিন্দু মারোয়ারী ব্যবসায়ীরা। দেশ বিভাগের পর এই ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই ভারতে চলে যায়। শিল্প ও ব্যবসাক্ষেত্রে এই শুণ্য স্থান দখল করে নেয় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা ব্যবসায়ীরা এবং শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত এদের প্রাধান্য অব্যাহত থাকে। ফলে বাংলাদেশে তেমন কোন উদ্যোক্তা শ্রেণীর গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি।

১৯৮২ সালে রপ্তানিমুখী শিল্পোন্নয়ন কৌশল গৃহীত হওয়ার মধ্যদিয়ে রপ্তানি শিল্পের সুযোগ সৃষ্টি হয়। উন্নত পুঁজিবাদী দেশে শ্রমের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় শ্রমনির্ভর পোশাক শিল্প অনুন্নত দেশে স্থানান্তর করা হয়। ৬০ ও ৭০ এর দশকে এসব শিল্পকে বাজার ও কোটা সুবিধা দিয়ে হংকং, তাইওয়ান ও দক্ষিন কোরিয়ার মত দেশে স্থাপন করা হয়। মাত্র দুই-আড়াই দশকেই এসব সুবিধা কাজে লাগিয়ে এসব দেশ নয়া শিল্পায়িত দেশে (ঘবষিু ওহফঁংঃৎরধষরুবফ ঈড়ঁহঃৎু তে বা ঘওঈ) পরিণত হয়ে উচ্চ মূল্যের পণ্য তৈরিতে চলে যায় এবং সস্তা মূল্যের পোশাক শিল্প বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশে চলে আসে।

বাংলাদেশের বিপুল সহজলভ্য উদ্বৃত্ত সস্তা শ্রম, কোটার সুযোগের পাশাপাশি সরকারী সুবিধা যেমন শুল্কমুক্ত আমদানী, ২৫ শতাংশ নগদ সহায়তা, ব্যাক টুক ব্যাক এল সি, বন্ডের ওয়ার হাউজ ফ্যাসিলিটি এবং  সর্বোপরি সংরক্ষিত বাজারের আকর্ষনে অনেকেই পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই এই ব্যবসায় নেমে পড়ে। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের পূর্বেই শ্রীলঙ্কার পোশাক শিল্প যাত্রা শুরু করে। কিন্তু আশির দশকের শুরুতে গৃহযুদ্ধের কারণে সেখানকার ক্রেতারা বাংলাদেশকেই উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেঁছে নেয়।

যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে শিল্প কারখানা স্থাপনে নিশ্চিত বাজার ও সরকারের প্রণোদনাসহ অপরাপর সুবিধার কারনে ঝুঁকি গ্রহনের প্রয়োজন হয় নাই। অর্থাৎ মূলধন সংগ্রহ, বাজার অন্বেষণ, উপকরণের যোগান অনেকটা সহজেই পাওয়ায় ব্যবসার ন্যূনতম অভিজ্ঞতাহীন অনেকেই পোশাক শিল্পে প্রবেশ করে এবং সফলকাম হয়। পুঁজি, প্রযুক্তি, নিশ্চিত বাজার এবং ন্যূনতম মাত্রায় মূল্য সংযোজনের কারণে অনেকেই দীর্ঘদিন এই পোশাক শিল্পকে বাণিজ্য সহযোগী শিল্প হিসেবে অভিহিত করেছে। তবে নব্য শিল্পায়িত দেশের অনেকেই বাণিজ্য সহযোগী শিল্প দিয়ে শুরু করে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে।

পোশাক শিল্পের এই নব্য উদ্যোক্তাদের ওপর এক গবেষণায় দেখা যায় আগত উদ্যোক্তাদের শতভাগ এস.এস.সি পাশ, ৮৮.৯ শতাংশের অন্তত ব্যাচেলর ডিগ্রী, তন্মধ্যে ৩৬.১% বি.এ, ১৯.৪% বি.এস.সি. ইঞ্জিনিয়ার, ২২.২% এম. এস এবং ২.৮% এস.এস.সি। তাছাড়া ৫২.৮% যে কোন এক ধরনের ভোকেশনাল ট্রেনিং আছে এবং ৩২.২% বিভিন্ন স্তরে বিদেশে লেখাপড়া করেছে। এছাড়া শিল্পোদ্যোক্তাদের ৩৮.২% শতাংশের পরিবারের পেশা ব্যবসা ছিল। যদিও এ গবেষণা প্রায় ১৪ বছর আগের তথাপি এই তথ্য সমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আশাব্যঞ্জক এই জন্য যে, এই প্রথম এক ঝাঁক অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত অপেক্ষাকৃত তরুণ বাঙ্গালী উদ্যোক্তার খাতায় নাম লিখিয়েছে। তারা সবাই যে সত্যিকারের উদ্যোক্তার গুণাবলী অর্জন করতে পেরেছে তা মোটা আলোচনা সাপেক্ষ। তবে রমনী মোহন দেবনাথের বইতে যেমনটি বলা হয়েছে বাঙ্গালীর ব্যবসার চাইতে কেরানীর চাকরী বেশি পছন্দ, সেই অপবাদ কিছুটা হলেও দূর হয়েছে। আজকে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে আরো উচ্চ শিক্ষিতরা এই ব্যবসায় আসছে। এ শিল্পপতিদের অনেকেই উচ্চতর গবেষণা ও শিক্ষার জন্য নিজেরা যাচ্ছেন ও কারখানার কর্মকর্তাদের বিদেশে পাঠাচ্ছেন। তবে আজকের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে উদ্যোক্তা হতে হলে উচ্চ শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। তবে স্বল্প শিক্ষা নিয়েও অভিজ্ঞতা, শ্রম ও অধ্যবসায়ের কারনে অনেকেই খ্যাতিমান শিল্পপতিতে পরিণত হয়েছেন। বাংলাদেশেই ট্রাকের হেলপার থেকে এবং সাধারন শ্রমিক থেকে শিল্প মালিক হয়েছেন এমন উদাহরনও বিরল নয়।

সমাজ জীবনে পোশাক শিল্পের প্রভাব

পোশাক শিল্পের হঠাৎ আবির্ভাব এবং দ্রুত বৃদ্ধিতে আবেগ তাড়িত হয়ে অনেকেই একে পোশাক শিল্পের বিপ্লব অথবা সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হিসেবে অভিহিত করেন। অর্থনীতি তথা সমাজ জীবনে পোশাক শিল্পের আগমন এবং বিস্তারের ব্যাপক প্রভাব স্বীকার্য হলেও একে বিপ্লব বলা অতিরঞ্জিত বই কিছু না। ইউরোপে সংগঠিত মাত্র কয়েক দশকের শিল্প বিপ্লব হাজার বছরের কৃষি ভিত্তিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামন্তবাদী সমাজকে ওলোটপালট করে শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক সমাজে পরিণত করেছে। তেমন কিছু বাংলাদেশে ঘটেনি। যদিও ইংল্যান্ডে বস্ত্র শিল্প দিয়েই বিপ্লব শুরু হয়েছিল। জন কের ফ্লাইং শাট্ল্ , জেমস হারগ্রিবসের ¯িপনিং জেনি, রিচার্ড আকরাইটের ওয়াটার ফ্রেম, জেমস ওয়াটসনের স্টিম ইঞ্জিন, সামুয়েল ক্রম্পটনের পাওয়ার লুম- এসব যুগান্তকারী আবিষ্কার মানুষকে একদিকে যেমন দৈহিক শ্রম থেকে মুক্তি দিয়েছে তেমনি মানুষের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে চেতনাকে নাড়া দিয়েছে যা বাংলাদেশে বিরল। অপরদিকে হংকং, তাইওয়ান এবং কোরিয়াও বাংলাদেশের মতই পোশাক শিল্পের কোটা সুবিধা এবং নিশ্চিত বাজার সুবিধা পেয়ে শিল্পায়ন শুরু করে এবং তিন দশকেই উন্নত দেশের প্রযুক্তি আত্মস্থ করে দ্রুত শিল্পায়িত দেশে পরিণত হয়। এসব দেশের পরিবর্তনও অনেকটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মতই। তবে বাংলাদেশ রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প তিন দশক পূর্বে যাত্রা করলেও এসব দেশের মতো বিপ্লব বা বৈপ্লবিক পরিবর্তন কোনটারই ধারে কাছে যেতে পারেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতি বা সমাজ জীবনে যে পরিবর্তন এনেছে তা কোনভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

এ প্রসঙ্গে পোশাক শিল্পের একজন নারী নেত্রী শ্রমিকদের অবদান বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন আমরা মেয়েরা যদি পোশাক শিল্পে যোগ না দিতাম তাহলে এই ৩০ বছরে দেশে ১৬ কোটি মানুষের সাথে আরও দু কোটি মানুষ যোগ হতো। তার এই কথার তাৎপর্য বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। শিল্প খাতে অংশ গ্রহনের কারনে সমাজে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বর্হিবিশ্বেও প্রচার পাচ্ছে এবং এর জন্য পোশাক শিল্পের নারীদের অবদান সবচাইতে বেশি।

পোশাক শিল্পের সাফল্য অসামান্য হলেও প্রথমদিকে এ শিল্পের পরিবেশ অনুকূলে ছিল না। পোশাক শিল্পের পূর্বে রপ্তানি শিল্প বলতে কেবল পাট ও পাটজাত দ্রব্য ছিল, যার চাহিদা ক্রমন্বয়ে কমছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শুণ্যের কোঠায় ছিল। অভিজ্ঞ দূরদর্শী উদ্যোক্তার অভাবে রপ্তানি পণ্য বাজারে যোগ হচ্ছিল না। বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল দারিদ্র, দূর্ভিক্ষ, খরা, দূর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসক, সামরিকতন্ত্র আর রাজনৈতিক অস্থিরতার দেশ হিসেবে। বিদেশী পন্ডিত, কপট প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ একবার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আরেকবার “উন্নয়নের পরীক্ষাগার”  ইত্যাদি নানা আপত্তিকর বিশেষণে চিহ্নিত করেছেন। এমনই একটি নিরানন্দ হতাশাজনক পরিবেশ থেকে মাত্র ১০ বছরে এক ঝাঁক উদীয়মান উদ্যোক্তা ৫ লক্ষ লোকের (যার অধিকাংশই মহিলা) কর্মসংস্থান করে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষন করবেন এটা দেশী-বিদেশী অনেকেই কল্পনা করতে পারেনি। আড়াই দশকও পার হয়নি সেই পন্ডিতরাই বাংলাদেশের জন্য উদীয়মান টাইগার কিংবা “নেকস্ট ইলেভেন” ইত্যাদি বিশেষণ আবিষ্কার করছেন। আসলে আমরা মনোজগতে এখনও ঔপনিবেশের আছর থেকে বের হতে পারিনি। বিদেশীরা খারাপ বললে সেটাই মেনে মন খারাপ করি, আর উদীয়মান ব্যাঘ্র বললে উৎফুল্ল হই। বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়িও না আবার শক্তিশালী ব্যাঘ্রও নয়। এদেশে খনিজ সম্পদ নাই, লোক সংখ্যা বেশি এ কারনেই বাংলাদেশ “কেস ষ্টাডি” হয়ে যায়। কিন্তু পৃথিবীতে অনুন্নত বিশ্বে যে সমস্ত দেশ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ তার অধিকাংশ দেশই দরিদ্র বা চরম দরিদ্র। আবার জাপান, কোরিয়া খনিজ সম্পদে দরিদ্র হয়েও পৃথিবীর প্রাচুর্যের দেশ। আসলে সম্পদহীন বলে কোন দেশ নেই। অন্য কোন সম্পদ না থাকলেও মানব সম্পদ তো আছে! মানুষকে উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষন দিয়ে গড়ে তুলতে পারলেই সম্পদ সৃষ্টি হবে। মানব সম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন না করলেও পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থান ও সম্পদ সৃষ্টিতে আশা জাগিয়েছে। বিশেষ করে সমাজের অবহেলিত নারী সমাজের কর্মসংস্থানে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এতদিন নারী শ্রমিক প্রধানত কৃষি, কুটির শিল্প, গৃহকর্মী হিসেবেই নিয়োজিত ছিল। পুরুষ শ্রমিকের সমান এবং ক্ষেত্র বিশেষে বেশি শ্রম দিয়েও তাকে কম মজুরিতে সন্তুষ্ট থাকতে হতো। কুটির শিল্পে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিনা মজুরিতে কেবলমাত্র খাবারের বিনিময়ে দিনব্যাপী কাজ করতে হতো। এই অবহেলিত নারীদের সনাতন নিম্ন উৎপাদনশীল ক্ষেত্র থেকে তুলনামূলক উচ্চ উৎপাদনশীল পোশাক শিল্পে নিয়ে এসেছে। যদিও নিম্ন মজুরিতে তাদের আর্থিক দৈন্য কাটেনি, এখনও নূন্যতম মজুরী বোনাস এবং উন্নত কাজের পরিবেশ সৃষ্টিতে তাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে, কিন্তু পোশাক শিল্প প্রায় ৩০ লক্ষাধিক মহিলাকে শুধু শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতিই দেয়নি তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক পরিচয় দিয়েছে। তারা দেখছে তাদেরই নিপুন হাতে তৈরি পোশাক বাংলাদেশকে বিশ্বে নতুনভাবে পরিচয় করে দিচ্ছে।

শুরুতে মেয়েদের পোশাক শিল্পে যোগ দেয়া সুনজরে দেখা হয়নি এবং পরিবার তথা সমাজে নানা বিপত্তির সম্মূখীন হতে হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টেছে এবং পরিবারে তাদের মতামতকে আজ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। পরিবর্তন এসেছে এসব শ্রমিকদের শিক্ষা ক্ষেত্রেও। পোশাক শিল্পে যোগ দিয়েই তারা শিক্ষার মর্যাদা বুঝতে পেরেছে। তাদের ছেলে মেয়ে ভাই বোনেরা আজ স্কুল যাচ্ছে। দেশে প্রাথমিক শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে পোশাক শিল্পে যোগ দেয়ার কারণে। নিজে ১০ থেকে  ১২ ঘন্টা পরিশ্রম করেও ছেলে মেয়েকে স্কুলে পাঠাচ্ছে। পোশাক শিল্পের আশেপাশের  প্রাথমিক স্কুলগুলোতে তাদের ব্যাপক উপস্থিতিই তার প্রমাণ। আজ একজন নারী শ্রমিক কাজ শেষে বাড়ি ফিরে দেখেন তার মেয়ে বা বোন প্রতিবেশী বান্ধবীর সাথে কম্পিউটারে কাজ শিখছে, দু’দশক পূর্বে স্বপ্নেও কল্পনা করা যায়নি। এ ধরনের ঘটনা ব্যতিক্রম হলেও শুরু হয়েছে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। পোশাক শিল্পই এই আশা দেখিয়েছে।

সাম্প্রতিক দূর্ঘটনা, শ্রমিক অসন্তোষ ক্রেতা গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া

যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে, সত্তর দশকেই এই শিল্পের আগমন ছিল অনেকটা আকস্মিক। অভিজ্ঞ উদ্যোমী উদ্যোক্তা, দক্ষ প্রযুক্তি,  শ্রমিক ও ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে বাজার সৃষ্টি বা অনুসন্ধানের ঝুঁকি নিয়ে পোশাক শিল্প সৃষ্টি হয়নি। কোটা সুবিধা, সরকারী সহযোগিতা ও  সস্তা শ্রমের কারনেই এই শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। পোশাক শিল্পের এই হঠাৎ আগমন এবং দ্রুত বেড়ে ওঠা থেকে অনেকেই এর টিকে থাকা নিয়ে সন্দেহ করেছিলেন। বিশেষ করে ২০০৫ সালে কোটা ঊঠে যাওয়ার পর এই শিল্প বন্ধ হওয়ার আশংকা করেছিলেন। কিন্তু কোটা উঠে যাওয়ার পর এই শিল্প টিকে আছে এবং ২০০৮-০৯ সালে উন্নত বিশ্বে মন্দার সময়ও রপ্তানি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। ২০০৯-১০ সালে বাংলাদেশে রপ্তানি আয় ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা গত এক দশকে সবচাইতে বেশি।

যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে সস্তা শ্রমিকই পোশাক শিল্পের গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ। স্বল্প মজুরী যা চলতি বাজারে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট না হলেও শ্রমিকরা দলে দলে যোগ দিয়েছে এবং এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়েছে। তবে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, তার উপর অনিয়মিত বেতন ভাতা এবং কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের অভাবের কারণে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছে। এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো নিরাপত্তাহীনতা। একের পর এক অগ্নিকান্ডে প্রাণহানির ঘটনায় শ্রমিকরা আজ নিরাপত্তা নিয়েই বেশি আতঙ্কিত। বিশেষ করে ২০১৩ সালের রানা প্লাজার অগ্নিকান্ডে ১১শতের অধিক শ্রমিক নিহত এবং অসংখ্য শ্রমিক আহত হওয়ার ঘটনা শুধু দেশের ভিতরই নয় সারা বিশ্বের পোশাক শিল্পের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ইতোপূর্বেও অগ্নিকান্ডে শত শত শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটেছে অথচ প্রতিকারের তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গত দুই দশকে অসংখ্য শ্রমিক দূর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে মর্মান্তিক অগ্নিকান্ড ঘটেছে লুসাকা, সারাকা, শান নিটিং, স্মাট গার্মেন্টস, মাইকো সেয়োটার, হামীম, গরিব এন্ড গরিব, ফিনিকস, তাজরীন এবং সবচাইতে মর্মান্তিক যা গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে তা হলো রানা প্লাজা।

উল্লেখ্য, পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই  সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তড়িঘড়ি করে আবাসিক বাসাবাড়িতে দ্রুত কারখানা করা হয়েছে। বিল্ডিং কোড মেনে কারখানা তৈরি করে পোশাক শিল্প শুরু হয়নি। সুযোগ বা সময় বা পুঁজি বা কারিগরি দক্ষতা তেমন ছিল না। কিন্তু ৩৫ বছর এই শিল্প কারখানার বিপুল সংখ্যায় বৃদ্ধির পর পুরানো এই যুক্তি অচল। এটা শুধু পোশাক শিল্পের জন্য ক্ষতি নয় বরং মালিক-শ্রমিক তথা গোটা অর্থনীতির জন্যও ক্ষতি। একটার পর একটি দূর্ঘটনা ঘটছে কিন্তু বিচার হচ্ছে না। প্রতি ঈদে লঞ্চ ডুবিয়ে শত শত মানুষ মরলেও যেমন মালিকের বিচার হয় না, তেমনি পোশাক শিল্পেও যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। জাতির অস্তিত্বের স্বার্থেই সকল দূর্ঘটনার তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার হওয়া প্রয়োজন।

শ্রমিককের মজুরি বৃদ্ধির কথা উঠলেই বাজার হারানোর প্রশ্ন আসে। যখন বেতন ৬০০ টাকা ছিল তখনও একই প্রশ্ন বার বার এসেছে। অনেক শিল্প মালিক শ্রমিকের সস্তা মজুরিই টিকে থাকার উপায় মনে করেন, যা  উদ্যোক্তাসুলভ আচরণ নয়। যিনি কম দামে মান সম্পন্ন পণ্য বাজারে ছাড়তে পারবেন তিনিই টিকে থাকবেন। এর জন্য প্রয়োজন উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি। তার জন্য প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষ শ্রমিক। কিন্তু শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির কোন উদ্যোগ নাই। শুধু পরিবার চালানোর জন্য ৪ থেকে ৫ ঘন্টা যদি ওভার টাইম করতে হয় এবং এতে যদি পুষ্টিহীনতায় ভোগে তবে তাকে দিয়ে আর যাই হোক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির আশা করা যায় না। বেশ কিছু কারখানায় দেখা গিয়েছে যেখানে শ্রমিকদের দুপুরের খাবার, চিকিৎসা, ডে-কেয়ার সেন্টার এবং কিছুটা হলেও বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। সেখানে মালিকদের মুনাফা হ্রাস পায়নি এবং সেখানে শ্রমিক অসন্তোষও অনেক কম।

আমাদের পোশাক শিল্পের আরেকটি দূর্বলতা হলো গুটিকয়েক বাজার নির্ভরতা। সাম্প্রতিক দূর্ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিদেশী ক্রেতারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপর জোর দিয়েছেন এবং কমপ্লায়েন্স না মানলে পণ্য ক্রয় না করার হুমকি দিয়েছেন। ক্রেতা গোষ্ঠী বাংলাদেশে পৃথিবীর সবচাইতে নিম্ন মজুরির শ্রম ক্রয় করে ১০ ডলারের শার্ট ৪০ ডলারে বিক্রি করে সর্বোচ্চ মুনাফা করছেন। দূর্ঘটনার পর তাদের মায়াকান্নার শেষ নাই। কিন্তু তাদের মুনাফার এক শতাংশের  অর্ধেক শ্রমিকের কল্যাণে ব্যয় করলে শ্রমিকের কর্মস্থলের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেতো। অনেক কোম্পানি আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্র“তি দিয়েও তা পালন করেনি। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশ আমেরিকায় পোশাক রপ্তানীতে ফ্রান্সের চাইতে পাঁচগুন বেশি ট্যাক্স দেয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে যে ট্যাক্স দেয়, ফ্রান্স ৩০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে একই পরিমান ট্যাক্স দেয়। অর্থাৎ যদি ফ্রান্সের সমান ট্যাক্স দিতো তাহলে বাংলাদেশ প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারতো যা দিয়ে ৪০ লক্ষ পোশাক শ্রমিকের নিরাপত্তা অনেকাংশে নিশ্চিত করা যেত।

পোশাক শিল্পের চ্যালেঞ্জ

প্রায় সাড়ে তিন দশক পূর্বে শুরু করে দূর্বল অবকাঠামো, গ্যাস ও বিদ্যুত সমস্যা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা যা কম বেশি আজও বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও গার্মেন্টস টিকে আছে। কিন্তু এত দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতার পরেও কি এই শিল্প শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পেরেছে? এই প্রশ্নের জবাব কঠিন। তবে যখন দেখি শুরুতে যেভাবে বিদেশী ক্রেতারা এই শিল্পের প্রতিটি বিষয়ে নাক গলাতেন এবং ডিকটেট করতেন এখনও তেমনিই করছেন। তার অর্থ এখনও নির্ভরশীলতা কাটেনি। তবে একেবারেই যে কাটেনি, তা নয় । কয়েক বছর পূর্বে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিবৃন্দ পোশাক শিল্পের মালিকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন- বাংলাদেশ যেহেতু তুলা উৎপাদন করে না তাই পশ্চাৎ সংযোগ (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) শিল্পের প্রয়োজন নেই। এমন উদ্ভট যুক্তি শোনা মাত্রই আমাদের শিল্পপতিরা তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন এবং বলেছিলেন- যে সমস্ত দেশে পোশাক শিল্প গড়ে উঠেছে তার অধিকাংশই তুলা উৎপাদন করে না। এমনকি যেখানে পোশাক শিল্প দিয়েই শিল্প বিপ্লব হয়েছে কিংবা দেশকে শিল্পায়িত করেছে তারা কেউ তুলা উৎপাদনকারী দেশ নয়। পরে অবশ্য উপদেশকারীরা তাদের বক্তব্য তুলে নিয়েছিলেন।

তবে তিন দশকের বেশি সময় পার হওয়ার পরও আমাদের পোশাক শিল্প এখনও এ টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। এত দীর্ঘ সময়েও যদি এই শিল্প টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হয় তাহলে এখনও উদ্যোক্তারা উদ্যোক্তার বৈশিষ্ট অর্জন করতে পারেনি।  এখনও নিজস্ব ব্রান্ডের কোন পণ্য বিশ্ব বাজারে পরিচিত করাতে পারেনি। অবশ্য অনেক উদ্যোক্তাই আন্তর্জাতিক বাজার দখলে ক্রেতাদের সহযোগিতা ছাড়াই সফল হয়েছেন। তবে তাদের সংখ্যা স্বল্প। অথচ চীন একই সময়ে বাংলাদেশের পাশাপাশি স্বল্প মূল্যের পোশাক দিয়ে শুরু করেছিল। তারা আজ উচ্চমূল্যের উন্নত ও বৈচিত্রময় পণ্য তৈরি করছে। আর আমাদেরকে তাদের ছেড়ে দেয়া পণ্যের বাজারে প্রবেশের  সুযোগ দিচ্ছে। অর্থাৎ চীনে শ্রম মজুরি বেড়ে যাচ্ছে এবং বায়াররা তাদের ছেড়ে অন্য সস্তা শ্রমের দেশে চলে যাচ্ছে। এটা চীনাদের সংকট নয় বরং তারা একধাপ উপরে উঠে যাচ্ছে আর আমরা সেই গুটিকয়েক স্বল্পমূল্যের পণ্য নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছি। চীনের মত দক্ষিন কোরিয়া ও তাইওয়ানও একইভাবে দেশকে শিল্পায়িত করেছে। তাই আমাদেরকেও কৌশল পাল্টাতে হবে। শুধু সস্তা শ্রমমূল্যের উপর নির্ভর না করে উৎপাদনশীলতা এবং গুনগত মান বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে, সেই সঙ্গে প্রয়োজন পণ্যের বৈচিত্রকরণ এবং বাজারের সম্প্রসারণ বা সমান্তরাল সম্প্রসারণ।

উৎপাদনশীলতা ও গুনগত মান বৃদ্ধির ক্ষমতাকে বলা হয় উন্নয়নের ইঞ্জিন। এই ইঞ্জিন কাজ করে উন্নত প্রযুক্তি এবং দক্ষ শ্রম শক্তি এই দুইয়ের সমন্বয়ে। আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তি নেই, প্রযুক্তি আমদানী নির্ভর। তবে প্রযুক্তি আমদানী করলেই উৎপাদনশীলতা বাড়বে না। প্রযুক্তির কার্যকারীতা নির্ভর করে তার প্রয়োগিক সাফল্যের উপর। প্রযুক্তি আমদানী করে আত্মস্থ  বা আত্মিকরন এবং সফল প্রয়োগের উদ্যোগ গ্রহন-এর জন্য প্রয়োজন দক্ষ প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ, টেকনিশিয়ান ও দক্ষ শ্রমিক এবং প্রয়োজন আর এন্ড ডি (জ ্ উ) তে ব্যাপক বিনিয়োগ।

জাপান ১৮৬৮ সালে মেইজী পুনর্বাসনের সময় প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে ইউরোপের তুলনায় একশত বছর পিছিয়ে ছিল। কিন্তু তারা প্রযুক্তি উদ্ভাবনে না গিয়ে আমদানিকৃত প্রযুক্তি আত্মিকরন করে জাপানী পরিবেশে সফল প্রয়োগ ঘটায়। যার নাম দিয়েছিল পশ্চিমা প্রযুক্তি জাপানী উদ্দীপনা “ডবংঃবৎহ ঞবপযহড়ষড়মু ঔধঢ়ধহবংব ঝঢ়রৎরঃ” এই কৌশল গ্রহন করে মাত্র ৩০ বছরে শত বছর পিছিয়ে পড়া জাপান উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছেছিল। ঠিক অনেকটা একই কায়দায় না হলেও তাইওয়ান ও দক্ষিন কোরিয়া গবেষণার মাধ্যমে উন্নত দেশের প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে দেশকে শিল্পায়িত করেছেন।

আমাদের শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, পণ্যের বৈচিত্রকরণ, উচ্চ মূল্যের পণ্য উৎপাদনের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি ও কাজের পরিবেশ উন্নয়নের বিকল্প নাই। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে শ্রমিককের বেতন বৃদ্ধি এবং তার নিরাপত্তা ও জীবনের মান উন্নয়নের বিষয়টিও অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।

এতদিন গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ প্রধান সমস্যা ছিল আজ তার কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও এটি এক নম্বর সমস্যাই আছে। এখনও বেশ কিছু উৎপাদক কারখানা স্থাপন করে গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পরেছে না। সেই সাথে অবকাঠামো উন্নয়ন বিশেষ করে ঢাকা চট্টগ্রাম চার লেন হাইওয়ে এবং ডাবল রেললাইল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্পন্ন করা প্রয়োজন। এছাড়াও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে এখনও বিনিয়োগকারীরা আস্থা অর্জন করতে পারছে না। আগামীতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তার উপরও এই শিল্পের ভবিষ্যত অনেকাংশে নির্ভর করছে।

উপসংহার

পোশাক শিল্প দেশের শিল্পায়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ৪০ লক্ষ শ্রমিককে উৎপাদনশীল কাজে অন্তর্ভূক্ত করে দারিদ্র বিমোচনে অবদান রেখেছে। এ শিল্পের সম্ভাবনা প্রচুর। পোশাকের চাহিদা কোনদিনই কমবে না। বর্তমানে বিশ্বে এই পণ্যের বাজার ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের। চীন একাই ১৬০ বিলিয়ন ডলার বা ৩৫.৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রন করছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের অংশ ৫.৪ শতাংশ (২৪.৪৯ বিলিয়ন ডলার)।  প্রথম দিকে যেনতেন ভাবে করাখানা গড়ে উঠেছে। শ্রমিকের মজুরি, নিরাপত্তা, পৃথক গার্মেন্টেস ভিলেজ এবং প্রযুক্তি উন্নয়নের বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি। এতদিন ক্রেতাদের চাহিদা মত পণ্য তৈরী হয়েছে। স্বল্প মেয়াদী লাভের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী স্বার্থ গুরুত্ব পায়নি। উপেক্ষিত হয়েছে পণ্য বৈচিত্রকরণ, দক্ষতা ও গবেষণা। ফলে আজও কেবল টিকে থাকার চেষ্টাই চলছে। আসলে উন্নয়ন ঘটে একটি ভিশনকে সামনে রেখে। এই  “ভিশন” মূলত দীর্ঘ মেয়াদী। তেমনি একটি “ভিশন” কে সামনে রেখে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিরুপন করা এবং সেই অনুযায়ী অগ্রসর হওয়া জরুরী।

উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, উদ্ভাবন, কাজের পরিবেশ সৃষ্টি, শ্রমিক মালিকের সম্পর্ক উন্নয়ন শুধু এই শিল্পখাতের উন্নয়নের জন্যই  নয় বরং গোটা অর্থনীতির স্বার্থেই জরুরী। আর মাত্র ৭ বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। শুধু টিকে থাকা নয়, পোশাক শিল্পকে আরও কয়েক ধাপ উন্নত স্তরে নিয়ে শ্রমিক-মালিক-শুভাকাঙ্খী একত্রে সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবে এটাই হোক প্রত্যাশা।

তথ্য নির্দেশ

১. বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতিঃ মজুরি প্রশ্ন, গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন এবং গণতন্ত্রের লড়াই, ঢাকা ২০১৩।
২. প্রতিমা পাল মজুমদার, সালমা চৌধুরী জহির, পোশাক কারখানাঃ নারী শ্রমিকের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষা, ঢাকা ১৯৯৪।
৩. বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা।
৪. লেনিন আযাদ, বিপন্ন বাংলাদেশঃ রাষ্ট্র, সমাজ ও উন্নয়নের এনজিও মডেল, ঢাকা ১৯৯৭.
5. M. Kuddus, S. Rashid Enterpreneurs and Economic Development: The Remarkable Story of Garment Exports from Bangladesh. UPL Dhaka 2002.
6. J. Faaland and J. R. Perkinson Bangaldesh, The Test Case of Development. Delhi, 1977.
7. M. Morishima, Why has Japan Succeeded? Western Technology and the Japanese Ethos. Cambridge, 1982.
8. P. Deane, The First Industrial Revoultion, Cambridge 1969.
9. Z. Chodhury, et. al. Women in Readymade Garment Industry, Draft Paper, Dhaka 2014.

Share This