মেধা পাচার: দেশের অগ্রগতির পথে বড় অন্তরায়

ড. শফিক উজ জামান
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
পরিচালক, অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মেধা পাচার বলতে সাধারণত বুঝায় কোন দেশের মেধাবী শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষ জনশক্তির নিজ দেশ ত্যাগ করে বিদেশকে কর্মক্ষেত্র হিসেবে স্থায়ীভাবে বেছে নেয়া। এই মেধা পাচার ঘটে সাধারণত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ থেকে। কম বেশি সকল দেশেই এই সমস্যা আজ প্রকট। ফলে মেধা পাচারের হ্রাস টেনে ধরতে আজ সকল দেশই তৎপর। কেননা কোন দেশ কতটুকু বিকাশমান তা নির্ভর করে সেদেশের মেধাবী তথা দক্ষ জনশক্তিকে কাজে লাগানোর সামর্থের উপর। এই মেধা পাচার সব ধরনের বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্রে ঘটলও ডাক্তার, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ প্রধানত যাদের উপর দেশের অগ্রগতি নির্ভরশীল এই শ্রেণীর মেধাবীরাই অধিক হারে দেশ ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমান। মেধা পাচারকে অন্যভাবে মানব পুঁজি পাচারও বলা হয়। কেননা সাধারণ শিক্ষার্থীরাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠনে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ হয়ে সৃষ্টিশীল কাজে অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেশকে এগিয়ে নিতে নিজে একজন সাধারণ মানব থেকে স্থায়ী পুঁজি বা মানব মূলধনে পরিণত হয়। যে দেশ যত বেশি এই মানব পুঁজি সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিয়েছে সে দেশের অগ্রগতি তত ত্বরান্বিত হয়েছে। পৃথিবীতে একটি দেশও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে দেশটি মেধাকে অবহেলা করে এগিয়ে গিয়েছে। অনেক দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েও দক্ষ মানব সম্পদের অভাবে দারিদ্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। নাইজেরিয়া, ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, সুদান, বলিভিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, মিয়ানমার, এমন কি মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি তেল উৎপাদনকারী দেশও এই তালিকাভুক্ত। অপর দিকে প্রাকৃতিক সম্পদে অত্যন্ত দরিদ্র জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড শুধুমাত্র মানব মূলধন (Human Capital) কাজে লাগিয়ে আজ বিশ্বে তাক লাগানো অগ্রগতি অর্জন করেছে। প্রাকৃতিক সম্পদ আর মানব মূলধনের পার্থক্য হলো প্রথমটির মজুদ একদিন শেষ হয় কিংবা অতিব্যবহার ও অতিনির্ভরতার কারণে এই সম্পদ শেষ হলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এমনকি দ্রুত ও অসতর্ক ব্যবহারের ফলে পরিববেশ বিপর্যয়ে দেশকে দীর্ঘস্থায়ী সংকটে ফেলে দেয়। অপরদিকে, মানব মূলধন ব্যবহার বা মেধার লালন যত বেশি হবে তার সৃষ্টিশীলতা বা উৎকর্ষতা তত বৃদ্ধি পাবে। খনিজ সম্পদ অতি ব্যবহারে যেমন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, ঠিক তার উল্টোটাই ঘটে মেধার তথা মেধাবীদের লালনের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের অগ্রগতির সবচাইতে বড় অন্তরায় এদেশের বিপুল জনগোষ্ঠিকে মানব সম্পদে রূপান্তরিত করার ব্যর্থতা, মেধাবীদের মূল্যায়নে ব্যর্থতা।

একটি মানুষ দরিদ্র হতে পারে। কিন্তু দেশ কখনও দরিদ্র হতে পারে না। কেননা মানুষই সে দেশের ভাগ্য নিয়ন্তা। বলা হয বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে দরিদ্র কিংবা সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের দেশ, এই কথাগুলি আদৌ সত্য নয়। বাংলাদেশ শ্রমশক্তিতে প্রাচুর্যের দেশ। উন্নয়নের মূলে আছে শ্রম। এই শ্রমের সাথে মেধা যুক্ত হলে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়। কিন্ত প্রকৃত মেধাবীদের কাজে লাগাতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাই দারিদ্রের কারণ।

বাংলাদেশে পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি ছাড়াও রয়েছে অঢেল মিঠা পানি, উর্বর মাটি, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, কুয়াকাটায় সূর্যোদয় ও সুর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য, বিশ্বের সবৃবৃহৎ ম্যানগ্রোভ এবং বিপুল মৎস্য ও খনিজ সম্পদসহ বিশাল সমুদ্র। এসবই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারেই দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে পারে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা উদ্যোগ এবং তা বাস্তবায়নে দক্ষ মানব সম্পদকে কাজে লাগানো। কিন্তু আজও তেমন কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ না থাকার ফলে এই বিপুল স্বম্ভাবনা থেকে জাতি বঞ্চিত।

আসলে জ্ঞান বিজ্ঞানের অভাবনীয অগ্রগতির যুগে যখন প্রতিটি দেশই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বিজ্ঞানীদের প্রণোদনা বৃদ্ধিসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে নিত্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও বিকাশে মনোযোগ দিয়েছে তখন আমাদের দেশ বিজ্ঞানীদের কাজে লাগাতে ব্যার্থ হচ্ছে। ফলে পাচার হচেছ মেধা। দেশ তেকে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই আর ফিরে আসছেন না। অথচ এই কৃতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সমাপনে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। উল্লেখ্য সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রীপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর পিছনে ব্যয় হচ্ছে ৫ লাখ টাকার অধিক, একজন বুয়েটের শিক্ষার্থীর শিক্ষা সমাপনীতে ব্যয় হচ্ছে ১০ লাখ টাকা আর একজন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর পিছনে ১৫ লাখ টাকার উপর। দরিদ্র দেশের এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে জনগণের করের টাকায়। অথচ মেধা পাচারের সুফল ভোগ করছে উন্নত জনগণের করের টাকায়। অথচ মেধা পাচারের সুফল ভোগ করছে উন্নত বিশ্ব। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল এই তিরিশ বছরের মধ্যে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা অনুন্নত বিশ্ব থেকে এক মিলিয়ন কারিগরি ও পেশাদার ব্যক্তি গ্রহণ করেছে। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীদের উন্নত বিশ্বে অভিবাসন নি:সন্দেহে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নত বিশ্বের এতে লাভ অনেক। প্রথমত তারা বিনা খরচে অনুন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানী ও দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছে যা দিয়ে তাদের নিজস্ব ঘাটতি পূরণ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত অপেক্ষাকৃত কম বেতনে এদের উদ্ভাবনী শক্তি ব্যবহার করে অগ্রগতি আরও ত্বরান্বিত করা যাচ্ছে। অপর দিকে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচেছ অনুন্নত বিশ্ব। এতে ধনী ও দরিদ্র দেশসমূহের ব্যবধান আরও বেড়ে যাচেছ। কেননা উন্নত ও অনুন্নত বিশ্বের ব্যবধান মূলত: প্রযুক্তিগত। প্রযুক্তি উন্নয়নের নিয়ামক। একটি দেশ আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে পশ্চাৎপদতার অর্থ দেশটি প্রযুক্তিতে পশ্চাৎপদ। প্রযুক্তির উদ্ধাবন, আত্মস্থকরণ এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ। কিন্তু বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদগণ যদি মেধা পাচারের কবলে পড়েন তাহলে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটবে না। দেশ পশ্চাৎপদ থেকে যাবে। তাই উন্নত বিশ্বের একটি অদৃশ্য নীতি আছে যাতে অনুন্নত দেশ থেকে প্রযুক্তিবিদদের সুযোগ সুবিধা দিয়ে তাদের উন্নত দেশে নেয়া আর তার নিজ জন্মভূমিকে বঞ্চিত করা। ঠিক উপনিবেশের অবসানে পশ্চিমা উন্নত দেশসমূহ যেমনি ঋণ আর সাহায্যের নামে নিজেদের বশংবদ সরকার প্রতিষ্ঠা করে পরোক্ষ উপনিবেশ জিইয়ে রেখেছে যা নয়া উপনিবেশ নামে পরিচিত, তেমনি মেধাবীদের বিভিন্ন সুযোগ দিয়ে উন্নত দেশের প্রতি অনুগত রাখছে।

তবে একজন্য দরিদ্র দেশের শাসকবর্গ কম দায়ী নয়। অনুন্নত দেশের গণবিচ্ছিন্ন, স্বৈরাচারী শাসকবর্গের কারণে মেধাবীরা দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। অনুন্নত দেশের সামরিক স্বৈরাতান্ত্রিক সরকার, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল, দেশের মেধাবীদের বিজ্ঞান গবেষনায় পদে পদে বাধার সৃষ্টি করে তাঁদের সৃষ্টিশীলতাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়। যুগে যুগে ফ্যাসিবাদী, স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ও ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বিজ্ঞান গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রসারকে পদে পদে বাধা দিয়েছে। আজও ধর্মের নামে, ঐতিহ্যের নামে স্বার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার মুক্ত চিন্তাধারার প্রযুক্তিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষককে নানা নিয়ম কানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ রেখে তাঁদের সৃষ্টিশীলতাকে বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছে।

অবশ্য অনেকেই গবেষণায় নিজেদের সৃষ্টিশীলতার সম্ভাবনা হ্রাসের আশংকা থেকেই নিজ দেশ ছেড়ে উন্নত দেশে পাড়ি জমিয়ে সে দেশের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখেন। শাসক বর্গের অনীহার কারনেই দেশে ব্যাপক ভিত্তিক মেধাবী বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয়নি। হয়নি বিজ্ঞান ও গবেষনা ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। অথচ সীমিত সুবিধা সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা প্রায় ৫০টির অধিক উচ্চ ফলনশীল ধান আবিষ্কার করেছেন এবং যে বাংলাদেশকে একদিন “তলা বিহীন ঝুঁড়ি” বলে উপহাস করা হয়েছিল সে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্য উৎপাদনে এই বিপুল সাফল্যের পিছনে একদিকে যেমন কৃষকের অবদান রয়েছে তেমনি কৃষি বিজ্ঞানীদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চির খাদ্য ঘাটতির দেশকে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতার দ্বার প্রান্তে নিয়ে আসা এই বিজ্ঞানীরাও অবহেলার শিকার।

অথচ বিজ্ঞানীদের প্রয়োজনীয় বেতনসহ সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করলে এই চির খাদ্য ঘাটতির কলঙ্ক থেকে দেশকে উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত করা সম্ভব। বাংলাদেশের সর্বত্রই যেমন দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতাকে সম্মান ও পুরস্কৃত করার পরিবর্তে মেধাহীন, অদক্ষ, কর্মবিমুখ ও চাটুকারদের পুরস্কারের সংস্কৃতির শিকড় গেড়েছে; বিজ্ঞান গবেষনায় নিয়োগ ও পদন্নোতিতেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। যেমন বাংলদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউটে (বিএআরআই) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পরীক্ষায় ৩২টি পদের বিপরীতে মন্ত্রীদের সুপারিশই ছির ৪৬ জন প্রার্থীর অনুকুলে (দৈনিক ভোরের কাগজ ১১.১১.২০০৯)। হতাশা ও বঞ্চনায় বাংলাদেশ ধান গবেষানা ইনস্টিটিউটের ১১৫ জন বিজ্ঞানী চাকরী ছেড়েছেন (দৈনিক প্রথম আলো ২৪.০১.২০১৩)। এই চিত্র বাংলাদেশের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই।

“মেধা পাচার বলে কিছু নেই” এমন কথা বলে মেধা পাচারের সমর্থকারীরা মেধা পাচারকে স্বাভাবিক মনে করেন। কিন্তু উন্নত অনুন্নত বিশ্বের পর্বত প্রমাণ ব্যবধান কারও দয়া দাক্ষিণ্যের জন্য অপেক্ষা না করে নিজ সক্ষমতার বিকাশ ঘটানোর মাধ্যমেই কেবল ঘোচানো সম্ভব। দেশ ত্যাগে ইচ্ছুক বিজ্ঞানীদের বাধা দেয়া কিংবা নিরুৎসাহ করার অর্থ বিশ্বায়ন বিরোধী, পশ্চিমা বিদ্বেষ কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদে ঘৃত্তাহুতি নয়; বরং বিশ্বায়নের সুযোগ কাজে লাগাতেই নিজেদের সক্ষমতার বিকাশ দরকার। দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে উন্নত দেশের প্রযুক্তি গ্রহণ, আত্মস্থকরণ এবং তার সফল প্রয়োগের জন্য তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। দরিদ্র দেশে প্রযোজনীয় সংখ্যক ও যোগ্যতা সম্পন্ন বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ না থাকার কারণে উন্নত দেশের সাথে তাদের কার্যকর সহযোগিতা হয় না। উন্নত ও অনুন্নত দেশের মধ্যে সহযোগিতার ফল ঘরে তুলতে হলে নিজ দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ন্যূনতম বিকাশ প্রয়োজন। আর প্রয়োজন উন্নত দেশের বিজ্ঞানীদের পরামর্শ গ্রহণ করার মত যোগ্যতা সম্পন্ন বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ এবং দক্ষ জনশক্তি। এসব আপনা আপনিই হয় না। এজন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানীদের উপযুক্ত প্রণোদনা ও অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা দিয়ে উন্নত দেশের প্রযুক্তিবিদদের সাথে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।

তাছাড়া উচ্চতর প্রশিক্ষণ, ডিগ্রী কিংবা জ্ঞান লাভের প্রয়োজনে উন্নত দেশে গমন, এমন কি স্থায়ীভাবে বসবাসও দোষের কিছু না। কেননা বিদেশে থেকেও সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করা যায়। কিন্তু নিজ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা করে সরকারী অর্থ এং সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়ে শুধুই ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ লাভের জন্য বিদেশে স্থায়ী বসবাস কাম্য নয়।

দরিদ্র দেশ হিসেবে নিজ দেশের সীমাবদ্ধতা, প্রতিবন্ধকতা অস্বীকার করা; বাস্ততাকেই অস্বীকার করা। তবে অবস্থা নিশ্চয়ই আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈর শাসক কবলিত দেশের মত নয় যেখানে বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীগণ সেইসব স্বৈরশাসকদের চক্ষুশূল। উপযুক্ত প্রণোদনা, প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধার অভাবই প্রধান প্রতিবন্ধকতা। এসব প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী ও শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসতে হবে।

আমাদের দেশে মেধাবীদের মূল্যায়ন না করা ও গবেষকের অবহেলা সামগ্রিকভাবে শিক্ষা খাতকে যে দৃশ্যত গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছে, এটা তারই বহিঃপ্রকাশ। বিষয়টি রাজনৈতিক। আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা তাদের ছেলে মেয়েরা এদেশে পড়ে না। দেশের ৭৪% রাজনৈতিবিদদের সন্তান পড়াশোনা করে বিদেশে (মানব জমিন, ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৪)। গত কয়েক বছরে এই সংখ্যা নিশ্চয়ই আরও বেড়েছে। বর্তমানে (১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) হরতালের নামে এস.এস.সি সহ সকল শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ। এই শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে ধ্বংসাত্মক কাজে যেসব নেতা নেত্রীরা প্রত্যেক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত আছে, হয়তো তাদের সন্তানদের কেউই এ দেশে পড়ে না।

পরিশেষে, মুক্তিযুদ্ধের সময় জে. নিয়াজির প্রেস সচিব সিদ্দিক সালিকের লেখা বইয়ে ঘটনা তুলে ধরছি। “নাশকতামূলক প্রচেষ্টা নেয়ার অভিযোগে ১৯৭১ সালের জুন মাসের রোহনপুর এলাকায় (রাজশাহী জেলা) একটি বালককে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে কোম্পানি সদর দফতরে নিয়ে আসা হলো। কিন্তু কোন তথ্যই সে প্রকাশ করতে স্বীকৃত হল না। মুখ খোলানোর জন্যে যখন পদ্ধতিই ব্যর্থ হল তখন ‘মেজর আর’ তার স্টেনগান বালকটির বুকের ওপর চেপে ধরে বলল, ‘এই-ই তোমার জন্য শেষ সুযোগ। যদি মুখ না খোলো তাহলে বুলেট তোমার বুক চিরে বেরিয়ে যাবে।’ সে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু গেড়ে মাথা নুইয়ে মাটি চুম্বন করলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমি এখন মরতে প্রস্তুত। আমার রক্ত নিশ্চয়ই আমার পবিত্র ভূমির মুক্তিকে ত্বরান্বিত করবে।’ (নিয়াজির আত্মসমর্পনের দলিল, সিদ্দিক সালিক ভাষান্তর: মাসুদুল হক, পৃঃ ১০৮) এই বালক নিশ্চয়ই শিক্ষা ধ্বংস ও মেধা পাচার করে অপরের দয়া দাক্ষিণ্যে বেঁচে থাকার জন্য কিশোর বয়সেই হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করেনি।

Share This