মানবিক দায়বদ্ধতা এবং স্বেচ্ছাসেবা

এম. জাকির হোসেন খান
ভাইস-চেয়ারম্যান
চিন্তার চাষ

১৭৫৫ সালে এম. এফআর, ভলান্টিয়ার সর্ব প্রথম সামরিক সেবা প্রদানে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক (Volunteer) শব্দটি ব্যবহার করেন। সামাজিক সেবার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক শব্দটি প্রথম ১৬৩০ সালে ব্যবহৃত হয়।

বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত “নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো” প্রবাদটি অনেকে কৌতুক করে বললেও এ প্রবাদের ভেতরেই স্বেচ্ছাসেবার মূল অন্তর্নিহিত। মানবিক দাযবদ্ধতা  থেকে মানুষসহ সকল প্রাণীর কল্যাণে কোনো ব্যক্তি/ প্রতিষ্ঠানের নি:স্বার্থ প্রচেষ্টা চালানোই স্বেচ্ছাসেবা। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব এবং একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই স্বেচ্ছায় সেবা প্রদান করে, প্রকারান্তরে সেবা প্রদানকারী এর মাধ্যমে সেবা গ্রহীতার প্রতি তার দায়বদ্ধতা হতে মুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। প্রশ্ন জাগতেই পারে, আমরা কিভাবে অন্যের কাছে দায়বদ্ধ। এর উত্তরে স্বাভাবিকভাবেই বলা যায, পৃথিবীর এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে সারা জীবনে প্রাপ্ত প্রত্যেকটি সেবার সঠিক এবং সময়মতো মূল্য প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে।

শিশু অবস্থায় স্কুলে যাওয়ার সময় যে ব্যক্তিটি হাত ধরে রাস্ত পার করে নিরাপদে স্কুলে যেতে বা বাড়িতে ফিরতে সহায়তা করেছে তাদেরকে আমরা কতখানি মনে রেখেছি বা তার প্রতিদানই কি কখনো দেয়া সম্ভব? রাস্তায় দুর্ঘটনায় আহত হলে হাসপাতালে পৌছে দিয়ে কিংবা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এক ব্যগ রক্ত প্রদানের মাধ্যমে নাম না জানা যে বা যারা আমার মতো অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচাতে অবদান রেখেছে তার সঠিক এবং পকৃত মূল্য কী কোনো ব্যক্তির পক্ষে প্রদান করা সম্ভব? সে উপকারী ব্যক্তিটিকে কখনো খুঁজে বের করে দাযবদ্ধতা হতে মুক্তি হওয়ার চেষ্টা কী আমরা কখনো করেছি বা আদৌ তাদের সকলকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব? জীবনের কঠিন অর্থ সংকটে বিনা লাভে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে যে ব্যক্তিটি শুধু সাময়িক সহায়তাই করে নি, কাউকে প্রাচুর্য অর্জনে প্রত্যক্ষ অবদান রেখেছে সে সহায়তার প্রকৃত মুল্য কী প্রদান করা সম্ভব? সবগুলো প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় প্রকৃতই সম্ভব নয়। অর্থাৎ প্রত্যেকে সমাজের নিকট মানবিক এবং ব্যক্তিগত কারণেই দায়বদ্ধ। আর সে দায়বদ্ধতা হতে কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব, যদি স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে ব্যক্তি/ সমাজের প্রকৃত কল্যাণে নিজের সামর্থ অনুযায়ী অবদান রাখা সম্ভব। ১৭৫৫ সালে এম. এফআর, ভলান্টিয়ার সর্ব প্রথম সামরিক সেবা প্রদানে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক (Volunteer) শব্দটি ব্যবহার করেন। সামাজিক সেবার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক শব্দটি প্রথম ১৬৩০ সালে ব্যবহৃত হয়। স্বেচ্ছাসেবা মূলত: সামরিক ক্ষেত্রে প্রধানত: ব্যবহার হলেও আধুনিক কালে কমিউনিটিভিত্তিক / সামাজিক সেবার ক্ষেত্রেও স্বেচ্ছাসেবা (Volunteering) ব্যপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে প্রকৃতভাবেই কিভাবে ব্যক্তি এবং সমাজ লাভবান হতে পারেন তা আলোকপাত করেছেন বিভিন্ন সমাজ বিজ্ঞানী । জু এবং নেগাই (২০১১) এর মতে, “উন্নয়নশীল দেশে তৃণমূল পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবা প্রসারের মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে প্রকৃত সমন্বয় এবং একইসাথে সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহাযতা করতে  পারে। স্বেচ্ছাসেবার ক্ষেত্রে উচ্চ নৈতিকতার চর্চা ব্যক্তি/ প্রতিষ্ঠানের আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠা এবং চ্যালেঞ্জ মোকালেবলায় সাহস যোগায়; একইসাথে ইমানুয়েল কান্ট এর “কী ধরনের কাজ” বা স্বেচ্ছাসেবা (What ought I to do) সংক্রান্ত আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর পেতেও সহাযতা করে। এক্ষেত্রে তা স্বেচ্ছাসেবায় অংশগ্রহণকারীকে আত্ম প্রত্যয়ী হতে অর্থাৎ ব্যক্তির পছন্দনীয় নৈতিক বিশ্বাসের ওপর আস্থা অর্জন প্রধান অবদান রাখে। তাই, মুল্যবোধ, লক্ষ্য এবং সংস্কৃতিগত ভিন্নতা সত্ত্বেও উচ্চ নৈতিকতা থাকলে বিভিন্ন ব্যক্তি একত্রে একটি সংগঠনের আওতায় একই ধরনের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ বা স্বেচ্ছাসেবার বিস্তারে প্রকৃত অবদান রাখতে পারে। আর এভাবে উচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন বা নৈতিকতার চর্চাকারী যে কোনো প্রতিষ্ঠান সহজে অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠান যাদের নৈতিকতা / বিশ্বস্ততা প্রশ্নবোধক তাদের তুলনায় দ্রুত সাধারণ জনগণ এবং সরকারের আস্থা এবং সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়।

স্বেচ্ছাসেবা’র প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য কিংবা বাজার অর্থনীতি এবং সার্বজনীন কল্যাণের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারণে এর প্রয়োগগত এবং দর্শনগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সার্বিকভাবে এশীয় সমাজে সার্বজনীন কল্যাণের দৃষ্টিকোণ হতে স্বেচ্ছাসেবায় অংশগ্রহণ করে, যার মাধ্যমে ব্যক্তি অর্থনৈতিক বা বৈষয়িকভাবে লাভবান হওয়া তার লক্ষ্য হতে পারবে না। স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার যোগ্যতারও প্রমাণ পেতে পারে, কিংবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বা ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা র্জনের মাধ্যমে কারো দ্রুত কর্মসংস্থানও হতে পারে। আবার, এ ধরনের কর্মকান্ডের মাধ্যমে সামাজিক সম্মান অর্জনও হতে পারে, কিন্তু স্বেচ্ছাসেবার প্রকৃত লক্ষ্য হবে মানবিক এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ হতে স্বেচ্ছাসেবায় অংশগ্রহণ করা।

“মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কী মানুষ পেতে পারে না”, মূলত গানের এ দুটি লাইনের মাধ্যমেই স্বেচ্ছাসেবার মূল লক্ষ্য যে মানবিক মূল্যবোদের বহি:প্রকাশ তা ফুটে ওঠে। স্বেচ্ছাসেবার প্রকৃত উদ্দেশ্য হতে হবে তাই সুদুরপ্রসারী এবং তাতে মানবিক দায়বদ্ধতার বহি:পকাশ থাকতে হবে। সমাজে কোনো ব্যক্তির স্বেচ্ছাসেবা তখুনি প্রকৃত অর্থে সমাজের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে যদি পরিকল্পনা সুনির্দিষ্ট এবং সুদুরপ্রসারী হয় এবং নিরন্তরভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া যায়।

Share This