অর্থনীতির সবটুকুই অর্থ নয়

এ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
প্রধান উপদেষ্টা
ডিবেট অব হিউম্যঅনিটি-ডিএফএইচ

অতিক্রম করা মানুষের জীবনের স্বাভাবিক গতিধারা। মানুষ নিজেকে অতিক্রম করে- টপকে যায় সে অপরকেও। এর আপেক্ষিকতা দুর্বলকে সবলের পিছনে ফেলে দেয়। কিন্তু কেউ কি আর পেছনে পড়তে চায়? তাই সভ্যতার ছাঁচে ফেলা জীবন প্রতিযোগিতায় সকলেই ছোটে সামনের দিকে। একই কথা মানুষের সামষ্টিক জীবন অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় জীবনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অগ্রগামী দেশগুলো বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত।  আর উন্নয়নশীর দেশগুলো উদভ্রান্তের মত ছুটছে একটি শব্দের পেছনে। সেটি হচ্ছে উন্নয়ন। উন্নত দেশগুলো কর্তৃক আরোপিত কতগুলো গাণিতিক সূত্র এবং জিডিপি-র প্রবৃদ্ধিকে সকল সমস্যা সমাধানের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে অন্তরে প্রগাঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে শুধুই সামনে চলা এই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর । সভা সেমিনারে শুধুই হিসাব নিকাশ ও আর্থিক প্রবৃদ্ধির গণনা। উন্নয়ন শব্দ যেন শুধুই একটি আর্থিক বিষয়। আর এর বাস্তবাযনের মহান দায়িত্ব নিয়েছেন শিল্পায়নের নামে দেশের শিল্পপতিরা হিসবটা খুব সহজ শিল্পের মালিকের লাভ হলে দেশের জিডিপি বাজবে আর তাহলেই তো দেশ উন্নত হবে। এ ধরণের হিসাবের কারণেই উন্নয়নের রোল মডেলে শিল্প শ্রমিকদের স্বার্থ চিরকালই উপেক্ষিত থেকেছে। দাযসারা গোছের ট্রেড ইউনিয়ন ফর্মুলা ছাড়া বলার মত কিছুই নেই। মানুষের জীবন অমূল্য সম্পদ। কিন্তু প্রবল অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার এই অদ্ভুত সভ্যতায় মানুষের জীবনের যেন কোন মূল্যই নেই। যদি থাকতো তাহলে দেশের পোশাক শিল্পে একের পর এক দুর্ঘটনায় এভাবে শত সহস্র শ্রমিকের মৃত্যু ঘটতো না। আর পারিশ্রমিক আদায়ের দাবিতে পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের আন্দোলন তো বাংলাদেশের নিত্যকার ঘটনা।

গত নভেম্বর ২০১২ এ সংগঠিত তাজরীন দুর্ঘটনার ক্ষত এখনও শুকায়নি। এরই মধ্যে ঘটলো রানা প্লাজা ধ্বংসের মত মর্মান্তিক ঘটনা। সাভারের তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ডে পুড়ে গিয়েছিল ১২৪টি তাজা প্রাণ। আর রানা প্লাজার ধংসস্তুপ থেকে সরকারি হিসেবে প্রথমে চার দিনে উদ্ধার করা হয় প্রায় সাড়ে তিনশত লাশ, জীবিত উদ্ধার করা হয় আড়াই হাজার আর নিখোজ রয়েছে প্রায় ছয়শত জন। এরও আগে স্পেক্টাম গার্মেন্টসের বিল্ডিং ধ্বংসে নিহত হয় ৭৬ জন্ প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই বারংবার দুর্ঘটনা? যে জিনিস বারবার ঘটে তাকে কি দুর্ঘটনা বলা যায়? মালিকপক্ষ শ্রমিকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে শুধুই নিজ স্বার্থে ব্যবসা পরিচালনা করবে আর দুর্ঘনটনায় মারা যাবে অসংখ্য শ্রমিক, এ বিষযটি এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে আমাদের দেশে। আর সরকার এই বিষয়ে কঠোর কি করে হবে?  কারণ দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির মহান দায়িত্ব তো শিল্প মালিকরাই নিয়েছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিনির্মানে কী আর শ্রমিকদের স্থান রয়েছে? উন্নয়নের বিষয়ে শিল্পের প্রবৃদ্ধির চেয়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বরাবরই কম গুরুত্ব পেয়ে আসছে।

আমাদের জাতীয় জীবনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যে রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়, সাধারণ দৃষ্টিতে এবং প্রায়োগিক বাস্তবতায় তা অর্থ নামক প্রাণহীন দ্রব্যের মাঝে সীমাবদ্ধ। অথচ সামগ্রিক বিচারে অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানুষের জীবনের সার্বিক উন্নয়নেরই প্রতিফলন ঘটায়। অর্থ উপার্জনই শেষ কথা নয, মানুষের কল্যাণই হোক চূড়ান্ত বাস্তবতা।

Share This